দীর্ঘ দুই বছর ধরে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজারে চলছে এক অস্থির অবস্থা। প্রতিদিনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমশ বাড়ছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সরাসরি প্রভাব ফেলছে। বাজারের এ পরিস্থিতি কেন এতদিন ধরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে? সরকারের উদ্যোগ সত্ত্বেও কেন সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না?
চাহিদার তুলনায় সরবরাহের ঘাটতি, আমদানিনির্ভরতা এবং সিন্ডিকেটের কারণে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে। সরকারের পদক্ষেপ এবং বাজার তদারকি ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা।
ভোগ্যপণ্যের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কেন ব্যর্থ হচ্ছে সরকার?
গত দুই বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে ডিম, আটা, ডাল এবং পেঁয়াজের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আমদানিনির্ভর বাজার, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট, এবং বাজার তদারকির অভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাসে বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভোগ্যপণ্যের গড় দাম বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, আটার দাম বেড়েছে ১১ শতাংশ, মসুর ডালের দাম ১৫.৪০ শতাংশ এবং ডিমের দাম বেড়েছে ২১.৩৪ শতাংশ। অন্যদিকে, চাল, তেল এবং পেঁয়াজের দাম কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও তা সাধারণ মানুষের জন্য তেমন স্বস্তিদায়ক নয়।
টিসিবির হিসাবে দেখা যাচ্ছে, গত এক বছরের ব্যবধানে এসব ভোগ্যপণ্যের দাম ১০ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সিন্ডিকেটের প্রভাবের কারণে বাজারের ওপর সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তবে এখনো সে হস্তক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
মূল্যস্ফীতি কমছে, কিন্তু জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে কি?
আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মাস জুলাইয়ে দেশে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১১.৬৬ শতাংশ, যা ছিল সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা এক যুগের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা গেলেও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এর প্রভাব এখনও সীমিত।
বিবিএস-এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৯২ শতাংশে এসেছে, তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ১০ শতাংশের ওপরে।
এলসি এবং সিন্ডিকেটের কারণে বাজারের অস্থিরতা কীভাবে বেড়েছে?
অর্থনীতিবিদদের মতে, গুটিকয়েক কোম্পানিকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার অনুমতি দেওয়ার কারণে বাজারে একটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এ সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং এর ফলে সাধারণ জনগণ আরো বেশি চাপে পড়ছে। বিশেষ করে চাল, তেল এবং আটার মতো প্রয়োজনীয় পণ্য এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “মূল্যস্ফীতির কিছুটা নিম্নগামী প্রবণতা দেখা গেলেও মানুষের জীবনযাত্রার মানের অবনমন অব্যাহত রয়েছে। সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাজারের স্থিতিশীলতা অর্জন করা যাচ্ছে না।”
বাজারে পণ্যের দাম কমছে না কেন? করপোরেট কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ কি প্রধান কারণ?
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, করপোরেট কোম্পানিগুলো চাল, আটা, তেল এবং পোলট্রির মতো ভোগ্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতে রাখছে। এর ফলে দাম কমানোর প্রচেষ্টা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। পাইকারি ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সরকারি সংস্থাগুলো করপোরেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর অভিযান পরিচালনা করতে পারছে না।
কারওয়ান বাজারের চালের পাইকার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “করপোরেট কোম্পানিগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে বাজারের অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে, অথচ তদারকি সংস্থাগুলো আমাদের মতো খুচরা এবং পাইকারি বিক্রেতাদের ওপর অভিযান চালাচ্ছে। মূল সমস্যার উৎসে হস্তক্ষেপ না করে নিচের স্তরে অভিযানের কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।”
ভোক্তাদের কীভাবে নিরাপত্তা দেবে সরকার?
অর্থনীতিবিদ এবং বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারি সংস্থাগুলোর আন্তরিকতা এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। বিশেষত ভোক্তা অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে শক্তভাবে বাজার তদারকিতে নামতে হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন মনে করেন, “সাধারণ জনগণ গত ১৫ বছরে ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের কোনো সুবিধা পায়নি। করপোরেট কোম্পানিগুলো সরকারের কাছাকাছি থেকে সুবিধা নিয়েছে।”
মূল্যস্ফীতির সাথে কীভাবে মোকাবিলা করবে দেশ?
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, খাদ্য উৎপাদনের ঘাটতি, এবং আমদানিনির্ভরতা বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে খাদ্য আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ৩৬ শতাংশ, যার মধ্যে গম আমদানি বেড়েছে ৭১ শতাংশ।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, মুদ্রানীতির পাশাপাশি রাজস্বনীতি এবং ভোগ্যপণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনার প্রতি জোর দিতে হবে। সরকার যদি ভোক্তা অধিদপ্তর এবং প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রমকে আরো জোরদার করতে পারে, তবে বাজারে সিন্ডিকেটের প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ভোগ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীলতায় কার্যকর পদক্ষেপ কি নেওয়া হচ্ছে?
সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতির নিম্নমুখী প্রবণতা সামগ্রিক অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি দিলেও বাজার স্থিতিশীলতার জন্য আরও অনেক দূর যেতে হবে। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইনের মতে, ভোগ্যপণ্যের বাজারের অস্থিতিশীলতা এবং সিন্ডিকেটের প্রভাব নিরসনে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
সাধারণ জনগণের জন্য স্বস্তি আনতে হলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং বাজার তদারকি বাড়ানো অপরিহার্য বলেও মন্তব্য করেন তিনি।