রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদমতামতহজ প্যাকেজ: শুভঙ্করের ফাঁকি নাকি হাজীদের প্রতি অবিচার?

হজ প্যাকেজ: শুভঙ্করের ফাঁকি নাকি হাজীদের প্রতি অবিচার?

মাওলানা শামছুল ইসলাম হাকেমী

হজ মুসলিমদের জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। জীবনে একবার হলেও পবিত্র কাবা শরীফে গিয়ে হজ পালন করার আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে বিদ্যমান। কিন্তু যখন সরকার হজের খরচ কমানোর নামে এমন কৌশল অবলম্বন করে যা বাস্তবে হাজীদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়, তখন প্রশ্ন উঠতে বাধ্য—এটা কি শুভঙ্করের ফাঁকি নাকি হাজীদের প্রতি অবিচার?

সম্প্রতি সরকার ২০২৫ সালের হজের জন্য দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। প্রথম প্যাকেজে খরচ ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা, যা “আজিজিয়া প্যাকেজ” নামে পরিচিত। দ্বিতীয় প্যাকেজে খরচ ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। প্রথম নজরে মনে হতে পারে, হজের খরচ কমেছে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই?

খাবারের খরচ বাদ দিয়ে খরচ কমানোর অভিনব কৌশল

সরকার এবার প্যাকেজের মধ্যে খাবারের খরচ অন্তর্ভুক্ত করেনি। প্রত্যেক হাজীকে খাবারের জন্য ৪০,০০০ টাকা এবং কুরবানির জন্য ৭৫০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ২৩,৮৫৯ টাকা) সঙ্গে নিতে হবে। আগের বছরগুলোতে খাবারের খরচ প্যাকেজের মধ্যে ধরা হতো। তাহলে খরচ কমলো কোথায়? বরং খরচ বেড়েছে। গত বছর দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে আবাসনসহ হজ প্যাকেজের খরচ ছিল ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা, যেখানে খাবারের খরচ অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবার একই প্যাকেজে খাবারের ৪০,০০০ টাকা বাদ দিয়ে খরচ ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। খাবারের খরচ যোগ করলে প্যাকেজের মোট খরচ দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৫ হাজার ৬৮০ টাকা। অর্থাৎ, খরচ কমেনি, বরং বেড়েছে প্রায় ৩৬,৮৪০ টাকা।

দূরত্বের ফাঁদ: বয়স্ক হাজীদের জন্য কষ্টের নামান্তর

৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকার আজিজিয়া প্যাকেজে আবাসন কাবা শরীফ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। বাংলাদেশের অধিকাংশ হাজী বয়স্ক, যাদের জন্য এই দূরত্ব থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা কতটা কষ্টকর হবে, তা সহজেই অনুমেয়। হজের সময় মক্কায় গাড়ি চলাচল সীমিত। তাই পায়ে হেঁটে এই দূরত্ব অতিক্রম করা বয়স্কদের জন্য প্রায় অসম্ভব। বাসে যাতায়াতের সুবিধা থাকলেও সময় মেনে চলা, যানজট এবং ভিড়ের কারণে তা আরেকটি চ্যালেঞ্জ।

আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, বাংলাদেশি হাজীরা সময় মেনে চলতে পারেন না। কেউ ঘুমিয়ে থাকেন, কেউ বাথরুমে, কেউবা আশপাশে ঘুরে বেড়ান। ফলে বাস মিস করা যেন নিয়মিত ঘটনা। অন্যদিকে, বিদেশি হাজীরা সময়ানুবর্তী, তাদের বয়সও কম। কিন্তু আমাদের দেশের বয়স্ক হাজীদের জন্য এই দূরত্ব থেকে হারাম শরীফে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা কতটা কঠিন হবে, তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন?

সুবিধা কমিয়ে খরচ কমানো: শুভঙ্করের ফাঁকি

মিনায় ‘ডি’ ক্যাটাগরির সার্ভিস সুবিধা দেওয়া হবে, যেখানে এয়ার কন্ডিশনের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। মক্কা ও মদিনায় প্রতি রুমে ছয়জনের আবাসন ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা হাজীদের জন্য অস্বস্তিকর। এত লোকের মধ্যে শেয়ার করে থাকা, বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য, কতটা কষ্টকর হবে? সরকারের উচিত ছিল এসব বিষয় বিবেচনা করে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা।

বিমান ভাড়ার বাস্তবতা: সিন্ডিকেটের খপ্পরে হাজীরা

সরকার বলছে, বিমান ভাড়া কিছুটা কমানো হয়েছে। কিন্তু সেটা কতটুকু? ২০১৯ সালে বিমান ভাড়া ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, যা ২০২২ সালে বেড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা হয়। ২০২৩ সালে তা বেড়ে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় পৌঁছায়। এবার কিছুটা কমানো হলেও, তা এখনো অনেক বেশি। অথচ ওমরার সময় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে প্রতিযোগিতার কারণে বিমান ভাড়া অনেক কম। হজের সময় যদি অন্য এয়ারলাইন্সগুলোকে অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে বিমান ভাড়া অনেক কমানো সম্ভব হতো।

সিন্ডিকেট ভাঙার প্রয়োজনীয়তা

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং সৌদি এয়ারলাইন্সের মধ্যে চুক্তির কারণে অন্য কোনো এয়ারলাইন্স হজ যাত্রী পরিবহন করতে পারে না। এই একচেটিয়া ব্যবসার ফলে বিমান ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। সিন্ডিকেট ভেঙে তৃতীয় ক্যারিয়ার বিমান সংস্থাগুলোকে সুযোগ দিলে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পেত, যা বিমান ভাড়া কমাতে সহায়তা করতো।

বেসরকারি এজেন্সির চ্যালেঞ্জ

বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো সরকারের প্যাকেজের সাথে সমন্বয় করতে পারছে না। অত দূরে আবাসন দিলে হাজীদের পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, ডলার ও সৌদি রিয়ালের মান বৃদ্ধির কারণে খরচ আরো বেড়েছে। বেসরকারি এজেন্সিগুলো সাধারণত ১,২০০ মিটারের বেশি দূরত্বে প্যাকেজ ঘোষণা করে না। এবার সরকারি প্যাকেজের সাথে সমন্বয় করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

হাজীদের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি: প্রশ্নবিদ্ধ

সরকার কি সত্যিই হাজীদের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছে, নাকি খরচ কমানোর নামে সুবিধা কমিয়ে তাদের কষ্ট বাড়াচ্ছে? হজ একটি পবিত্র ইবাদত। এতে কোনো প্রকার কষ্ট বা বিঘ্ন না ঘটে, তা নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমান প্যাকেজগুলো দেখে মনে হচ্ছে, সরকার শুধু খরচ কমানোর বাহ্যিক প্রদর্শনী করছে, আসলে হাজীদের সুবিধা কমিয়ে দিয়েছে।

প্রস্তাবনা: কী করা উচিত ছিল?

বিমান ভাড়া কমানো: তৃতীয় ক্যারিয়ার বিমান সংস্থাগুলোকে অনুমতি দিয়ে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করা উচিত ছিল, যাতে বিমান ভাড়া কমে।

আবাসনের দূরত্ব কমানো: হাজীদের কাছাকাছি আবাসন নিশ্চিত করে তাদের কষ্ট লাঘব করা প্রয়োজন ছিল।

খাবারের খরচ প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত করা: খাবারের খরচ প্যাকেজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে প্রকৃত খরচ নির্ধারণ করা উচিত ছিল।

সুবিধা বাড়ানো: মিনায় এয়ার কন্ডিশনসহ সেবা নিশ্চিত করা এবং রুমে মানুষের সংখ্যা কমিয়ে আনা উচিত ছিল।

শেষ কথা: সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হোক

হজের খরচ কমানোর নামে সরকারের এই শুভঙ্করের ফাঁকি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। হাজীদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে, তাদের সুবিধা নিশ্চিত করে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা উচিত ছিল। হজ পালন মুসলিমদের ধর্মীয় কর্তব্য, এবং এতে কোনো প্রকার কষ্ট বা বিঘ্ন না ঘটে তা নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা আশা করি, সরকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে এবং হাজীদের জন্য সত্যিকারের সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক হজ প্যাকেজ ঘোষণা করবে।

লেখক : কলামিস্ট

এই বিভাগের আরও পড়ুন