রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদচট্টগ্রামকেন চট্টগ্রামের গণি বেকারির বেলা বিস্কুট এত জনপ্রিয়?

কেন চট্টগ্রামের গণি বেকারির বেলা বিস্কুট এত জনপ্রিয়?

নিজস্ব প্রতিবেদক

এক ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান, চট্টগ্রামের গণি বেকারি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলতে থাকা এই বেকারি কেবল একটি ব্যবসা নয়; এটি মানুষের স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা এক টুকরো আবেগ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্রতিষ্ঠিত গণি বেকারি চট্টগ্রামবাসীর হৃদয়ে এমন এক জায়গা করে নিয়েছে, যা সাধারণ বাণিজ্যের বাইরে গিয়ে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।

এই প্রতিষ্ঠানটি অনেকটাই যেন পরিবারের মতো হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে। ষাটের দশকের এক সন্ধ্যায় বাবা অফিস থেকে ফিরছেন বিস্কুটের প্যাকেট হাতে। সেই বিস্কুট নিয়ে বাড়ির শিশুদের মধ্যকার কাড়াকাড়ি, প্রতিদিনের আড্ডায় চায়ের সাথে বিস্কুট মাখিয়ে খাওয়া—সবই আজও স্মৃতির পাতায় জমা হয়ে আছে। এ বিষয়ে রুবিনা ইসলাম বাংলার পত্রিকাকে বলেন, “আব্বা যেদিন বাসায় বিস্কুট নিয়ে আসতেন, সেইদিনটা আমাদের কাছে একটা উৎসবের মতো হয়ে উঠতো। এখনো চট্টগ্রামে গেলে আমি সেই বিস্কুট কিনে নিয়ে আসি। যেন পুরনো দিনের সেই স্মৃতিগুলো আমার সাথে থাকলো।”

এই গল্প শুধু রুবিনার নয়; আরও অনেকের মধ্যেই এমন স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে। বখতেয়ার সম্রাট, যিনি বর্তমানে ২২ বছর বয়সী, শৈশবে তার বাবা প্রতি শুক্রবার কাজ শেষে গণি বেকারি থেকে বেলা বিস্কুট নিয়ে আসতেন। সম্রাট বাংলার পত্রিকাকে বলেন, “আমাদের দাদি ও ফুফু এই বিস্কুটের বড় ভক্ত ছিলেন। কিন্তু দাদির মৃত্যুর পর আব্বু আর তেমন বিস্কুট আনেন না। যেন দাদির স্মৃতির সাথে বিস্কুটের সম্পর্কটাও কিছুটা ফিকে হয়ে গেছে।”

চট্টগ্রামের গণি বেকারি কেবল একটি বেকারি নয়; এটি বন্দর নগরীর মানুষের মনের এক টুকরো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বেকারির নাম আরও প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সেনাদের জন্য রুটি বানাতো গণি বেকারি, প্রতিদিন শত শত সেনার জন্য। সেই সময় থেকে বেকারির প্রতি মানুষের আস্থা গড়ে উঠেছে, যা আজও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

বেলা বিস্কুটের আদি যাত্রা

বেলা বিস্কুট এক সময় ছিল যখন চট্টগ্রামে ‘বিস্কুট’ মানেই বোঝাতো বেলা বিস্কুট। সেখান থেকে শুরু করে আজও এই বিস্কুট রয়েছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে। দোকানে ঢুকতেই দেখা যায় বিভিন্ন ক্রেতার ভিড়। ৩০ ধরনের পণ্যের মধ্যে বেলা বিস্কুট সবথেকে বেশি বিক্রি হয়। এখানে পাওয়া যায় তিন ধরনের বেলা—সাধারণ বেলা, মাখন বেলা, এবং রোজ বেলা। মাখন বেলার মূল্য অন্যগুলোর তুলনায় বেশি; ৩০টি পিসের দাম প্রায় ১৫০ টাকা, সাধারণ এবং রোজ বেলার দামও প্রায় কাছাকাছি।

চট্টগ্রামের সকাল-বিকাল চায়ের সাথে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়া যেন এখানকার সংস্কৃতিরই একটি অংশ। শীতের সকালে বা গ্রীষ্মের বিকেলে চায়ের সাথে বেলা বিস্কুটের সেই সুখস্বাদ আজও চট্টগ্রামের মানুষের কাছে অপরিহার্য।

চট্টগ্রামের গণি বেকারির আদি ইতিহাস

বলা হয়ে থাকে, চট্টগ্রামের গণি বেকারি বন্দর নগরীর বেকারিশিল্পের সূচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গবেষকদের মতে, প্রায় ২০০ বছর আগে চট্টগ্রামে বেকারি শিল্পের প্রচলন হয়েছিল লাল খাঁ সুবেদার ও তার ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রির হাত ধরে। তাদের সময়ে চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের প্রভাব ছিল, যারা রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি খাবার খেতে পছন্দ করত। এমনই খাদ্যাভ্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবদুল গণি সওদাগর বেকারি পণ্যের প্রচলন করেন। সেই থেকে শুরু করে গণি বেকারি হয়ে ওঠে আস্থা ও ঐতিহ্যের প্রতীক।

প্রাচীন ঐতিহ্যের স্বাক্ষর

চট্টগ্রামের গণি বেকারির প্রাচীন পদ্ধতিতে বেকিং পদ্ধতির প্রতি নিবেদিত থাকার দৃষ্টান্ত বিরল। মাটির তৈরি চুলা, যাকে তন্দুর বলে, তাতেই তৈরি হয় এখানে বিস্কুট। বর্তমান সময়ের আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না করে তারা প্রাচীন তন্দুরেই নিজেদের ভরসা রাখে। “মেশিন ব্যবহারে স্বাদে ভিন্নতা আসে, তাই আমরা তন্দুরেই বিস্কুট বানাই,” বলেন বর্তমান কর্ণধার এহতেশাম। তিনি জানান, মাটির চুলা ব্যবহারের কারণে কিছুটা ঝামেলা হয়; মাটির প্রলেপ বারবার ঠিক করতে হয়, তবু ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে এই পদ্ধতিই অবলম্বন করেন তারা।

চট্টগ্রামের গণি বেকারির আরেকটি বিখ্যাত পণ্য বাকরখানি। এটি সাধারণ বাকরখানি থেকে ভিন্ন; মাংসের সাথে খাওয়া হয় এটি, বিশেষ করে ঈদ-উল-আজহায়। রসে ভরপুর এই মিষ্টি বাকরখানির কথা উঠলে পুরান ঢাকার নোনতা বাকরখানির কথা মনে আসলেও, চট্টগ্রামের বাকরখানি ভিন্ন, মিষ্টি এবং রসালো।

চট্টগ্রামের গণি বেকারির বাকরখানি

 

প্রজন্মের পর প্রজন্মের আস্থা

চার প্রজন্ম ধরে এই বেকারির মালিকানা চলে আসছে একই পরিবারের হাতে। এহতেশামের দাদা আবদুল গণি সওদাগর এই বেকারি প্রতিষ্ঠা করেন, তার মৃত্যুর পর দায়িত্ব নেন দানু মিয়া সওদাগর, তারপর এহতেশামের বাবা জামাল উদ্দিন, এবং বর্তমানে এহতেশাম এই ব্যবসার দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এই বেকারি চালানোর পেছনে এহতেশামের একমাত্র লক্ষ্য হলো প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখা, এবং সেই কারণে লাভ-লোকসানের হিসেব নিকেশেও তিনি তেমন গুরুত্ব দেন না।

তিনি বাংলার পত্রিকাকে বলেন, “আমার বাবা-দাদার যত্নে গড়া এই বেকারি অনেকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। ব্যবসার জন্য নয়, কেবলমাত্র ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য আমরা এই বেকারি চালিয়ে যাচ্ছি। বেশি লাভের জন্য শাখা খুলতে পারতাম, কিন্তু তাতে মানের সাথে আপস করতে হতো।” এহতেশাম এবং তার পরিবারের জন্য এই বেকারির পণ্য মানে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক দ্রব্য নয়, বরং এটি তাদের পূর্বপুরুষদের সৃষ্টি করা ঐতিহ্যের একটি অংশ।

পণ্যের মানে কোনো আপস নয়

গণি বেকারির প্রতিটি পণ্য মানের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়। অন্য কোনো বেকারির সাথে তুলনা করা যায় না তাদের পণ্যের স্বাদকে। কারণ, এখানকার পণ্য তৈরির পদ্ধতি অন্যান্য বেকারির চেয়ে একেবারেই আলাদা। ইস্ট ব্যবহারের পরিবর্তে তারা ‘মাওয়া’ নামক এক বিশেষ মিশ্রণ ব্যবহার করে। মাওয়ার এই পদ্ধতি গোপন রেসিপি হিসেবে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবহার করে আসছে গণি পরিবার, যা তাদের পণ্যের স্বাদকে করে তুলেছে একেবারেই আলাদা।

চট্টগ্রামের গণি বেকারি

ঐতিহ্য ও সুনামের টানে ক্রেতারা

শতাব্দী প্রাচীন এই বেকারির পণ্যের জন্য এখনও দূরদূরান্ত থেকে ক্রেতারা আসেন। তাদের মধ্যে অন্যতম রহিমা বেগম, যিনি তার বাবার সময় থেকে গণি বেকারির ক্রেতা। তিনি বাংলার পত্রিকাকে বলেন, “আমার বাবার সময় থেকেই আমরা এই বেকারি থেকে পণ্য কিনে আসছি। এই বেকারির প্রতি আমাদের একটা বিশ্বাস জন্মেছে। এখানকার পণ্যের মান সবসময়ই ভালো।”

এই বেকারি নিয়ে এহতেশামের আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা তিনি উল্লেখ করেন। চট্টগ্রামের কাঠগড় এলাকার এক ক্রেতা শুধু মাত্র দুই প্যাকেট বিস্কুট কিনতে গাড়িভাড়া বাবদ ৫০০ টাকারও বেশি খরচ করেন। এতে তার মনে একটি বিষয় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—গণি বেকারি এখনো মানুষের আস্থার নাম।

বেকারির নতুন শাখা খোলার সম্ভাবনা?

এই ঐতিহ্যবাহী বেকারির মালিকদের কাছে একাধিকবার প্রস্তাব এসেছে নতুন শাখা খোলার। কিন্তু এহতেশাম সেই সুযোগকে না বলেছেন। তার মতে, একাধিক শাখা থাকলে মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে যাবে এবং ক্রেতারা পুরনো স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন। “আমার কাছে পণ্যের মান এবং ক্রেতার আস্থা বেশি গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন তিনি।

বেকারি চালানো তার কাছে শুধু পেশা নয়; এটি পারিবারিক গর্বের একটি অংশ। পূর্বপুরুষদের আস্থার সাথে অর্জিত এই ঐতিহ্যকে তিনি অক্ষুণ্ণ রাখতে চান এবং এজন্যই কোনো শাখা খোলার পরিকল্পনা নেই তাদের।

চট্টগ্রামের গণি বেকারি

শেষ কথায় গণি বেকারি

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চট্টগ্রামের মানুষকে স্বাদ, সেবা এবং স্মৃতির সাথে যুক্ত রেখেছে গণি বেকারি। এর প্রতিটি পণ্যে রয়েছে এক টুকরো ইতিহাস, এবং প্রতিটি ক্রেতার মুখে থাকে সন্তুষ্টির হাসি। পণ্যের স্বাদ, ঐতিহ্যবাহী প্রস্তুত পদ্ধতি এবং পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধ এই বেকারিকে শুধু একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয় বরং চট্টগ্রামের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে।

চট্টগ্রামের গণি বেকারি বর্তমান মালিক এহতেশাম বাংলার পত্রিকাকে বলেন, “আমাদের এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি যে ভালোবাসা এবং আস্থা তৈরি হয়েছে সেটাই আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। লাভ-লোকসানের হিসাব নয়; আমি আমার বাবা-দাদার সৃষ্ট ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই।” চট্টগ্রামের প্রতিটি মানুষের কাছে গণি বেকারি কেবলমাত্র একটি বেকারি নয়, বরং একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান যা স্বাদ এবং স্মৃতির এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ।

এই বিভাগের আরও পড়ুন