চট্টগ্রামের নামকরণ নিয়ে ইতিহাসে নানা মতবিরোধ ও কাহিনি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভরপুর এই অঞ্চলটি শুধু প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের জন্যই নয়, বরং এর বৈচিত্র্যময় নামকরণের ইতিহাসের জন্যও বিশেষভাবে পরিচিত।
প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন রাজা, সুলতান ও বিদেশি বণিকদের অধীনে আসা এই জনপদের নাম বদলেছে বহুবার। “চৈত্যগ্রাম” থেকে শুরু করে “চাটিগাঁও,” “শাৎগাঙ,” “ইসলামাবাদ” এবং “চিটাগাং”—প্রতিটি নামের পেছনেই লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা সামাজিক প্রেক্ষাপটের আখ্যান। চট্টগ্রামের নামকরণের এই ধারাবাহিক বিবর্তন শুধু এর ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেনি, বরং এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যকেও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
চট্টগ্রামের হাজার বছরের পুরনো বন্দর
চট্টগ্রামের এই পুরাতন সমুদ্রবন্দরটির পরিচিতি কিন্তু আজকের নয়। ভ্রমণকারীদের মতে, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকেই চট্টগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। স্ট্রাবোর বিবরণ অনুযায়ী, সেই সময়েও চট্টগ্রামের এই বন্দরটি আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিতি লাভ করেছিল।
কর্ণফুলীর মোহনায় অবস্থিত এই বন্দরটি এশিয়া ও ইউরোপের মাঝামাঝি এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল, যা একে বহিরাগত শক্তিগুলোর কাছে বারবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছিল। চট্টগ্রামের এই বন্দরকে ঘিরেই যুগ যুগ ধরে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ইতিহাস, এবং তার সাথে এসেছে বহু নামের বিবর্তন।
নাম বদলের ইতিহাস: নানা আক্রমণ ও শাসকের হাত ধরে পরিবর্তিত চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম কখনও ছিল না কোনো একক রাজ্যের অধীনস্থ। ফলে, একে ঘিরে রয়েছে নানা রাজত্ব, নানা শক্তির ক্রমাগত আক্রমণের গল্প। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রাজা, সুলতান, বা শাসক এই জনপদটিকে নিজেদের অধীনে এনে রেখেছিলেন এবং প্রতিটি শাসকই এ শহরের নাম বদলাতে পছন্দ করতেন। ফলে, ইতিহাসে চট্টগ্রামের প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশটি ভিন্ন নামের সন্ধান পাওয়া যায়, যা গবেষক ও ইতিহাসবিদদের কাছে চট্টগ্রামের এক অনন্য ঐতিহ্য বলে বিবেচিত।
এই নামবদলের নানা নিদর্শন আমরা পেয়ে থাকি এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের পরিব্রাজক, ভূগোলবিদ ও ঐতিহাসিকদের বিবরণে, অঙ্কিত মানচিত্রে, এবং সেই সময়ের শাসকদের মুদ্রায়।
বৌদ্ধ চৈত্যের অবস্থান: চৈত্যগ্রাম নামের উৎপত্তি
চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রথম উল্লেখযোগ্য শাসকদের মধ্যে ছিলেন বৌদ্ধরা। বর্মী ইতিহাস অনুসারে, খ্রিস্টীয় সপ্তম ও অষ্টম শতকে চট্টগ্রাম বৌদ্ধ শাসকদের অধীনে ছিল। বাঙালি বৌদ্ধদের মতে, এ অঞ্চলে অসংখ্য বৌদ্ধ চৈত্য বা মন্দির থাকার কারণে এ স্থানের নামকরণ হয়েছিল “চৈত্যগ্রাম”। চৈত্য শব্দটি মূলত বৌদ্ধ মন্দির বা বিহারকে নির্দেশ করে। অনেকে মনে করেন, প্রাচীন আরাকানিরা বৌদ্ধদের স্বর্ণযুগে চট্টগ্রামের এই অঞ্চলটিকে “চিটাগুং” নামে ডাকতেন।
জালন্ধর: গরম পানির উৎস হতে উদ্ভূত একটি নাম
চট্টগ্রামের আরেকটি প্রাচীন নাম “জালন্ধর” বা “জলন্দর”। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, এই নামটির উৎপত্তি হয়েছিল জালন্ধরীপা নামক এক বৌদ্ধ সাধুর নাম থেকে।
অনেক ঐতিহাসিকের মতে, চট্টগ্রামের কিছু এলাকাতে তপ্ত জলধারা বের হওয়ায় এই নামকরণ করা হয়। তিব্বতি ঐতিহাসিক সুম্পা খান পো তার ‘পাকসাম জোন-জান’ গ্রন্থে লিখেছেন, কিছু জায়গায় ভূগর্ভস্থ আগুন থেকে তপ্ত জলধারা প্রবাহিত হওয়ায় এই নামকরণ হয়েছে।
আজও সীতাকুণ্ড ও বারবকুণ্ড এলাকায় এই তপ্ত জলধারা প্রবাহিত হতে দেখা যায়।
আরাকান রাজার যুদ্ধ বিরতির প্রতীক “চিৎ-তৌ-গৌং” থেকে চাটিগাঁও
খ্রিস্টীয় দশম শতকের দিকে চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অধীনে ছিল। সে সময় আরাকান রাজা বিদ্রোহী সুলতানকে দমন করতে এসে সীতাকুণ্ডে একটি বিজয় স্তম্ভ নির্মাণ করেন এবং সেখানে আরাকানি ভাষায় “চিৎ-তৌ-গৌং” শব্দটি উৎকীর্ণ করেন। এ শব্দটির অর্থ “যুদ্ধ করা অনুচিত” বা “যুদ্ধ থামাও”।
ঐতিহাসিকদের মতে, এভাবেই “চিৎ-তৌ-গৌং” নামটি বিকৃত হয়ে পরবর্তীতে “চাটিগাঁও” বা “চাটগাঁ” হয়ে যায়, যা চট্টগ্রামের অন্যতম পরিচিত একটি নাম।
“শাৎগাঙ” এবং আরব্য বণিকদের আগমনের গল্প
আরব্য বণিকদের কাছে চট্টগ্রাম পরিচিত ছিল “শাৎগাঙ” নামে। “শাৎ” অর্থ বদ্বীপ আর “গাঙ” অর্থ নদী, অর্থাৎ বদ্বীপে অবস্থিত এই শহরটি তাদের কাছে একটি বাণিজ্যিক পথ হিসাবে পরিচিত ছিল।
আরব ভূগোলবিদ আল ইদ্রিসীর লেখা থেকে জানা যায়, তাদের দৃষ্টিতে এই অঞ্চলটি ছিল গঙ্গার মোহনায় অবস্থিত এক অপার সম্ভাবনাময় বদ্বীপ। এভাবেই আরব বণিকদের কাছে “শাৎগাঙ” থেকে পরে “চাটগাঁ” এবং “চাটিগাঁও” নামের উৎপত্তি ঘটে।
পীর হযরত বদর শাহ (র.) এর আধ্যাত্মিক গল্প
চট্টগ্রামের নামকরণের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত কাহিনি হলো পীর হযরত বদর শাহ (র.)-এর আধ্যাত্মিক কাহিনি। বলা হয়, তিনি চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের জন্য এসেছিলেন এবং এই অঞ্চলে মন্দ আত্মাদের সঙ্গে এক আধ্যাত্মিক চুক্তি করে এক চাটি (মাটির প্রদীপ) পরিমাণ জায়গা প্রার্থনা করেছিলেন।
শর্ত ছিল, প্রদীপের আলো যতটুকু জায়গা আলোকিত করবে, ততটুকু জায়গা তার এবাদতের জন্য বরাদ্দ থাকবে। এই চাটির আলো ও আজানের ধ্বনি শুনে জীন-পরীরা স্থান ত্যাগ করে।
এর থেকেই “চাটিগাঁও” নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
ব্রাহ্মণদের প্রভাব ও চট্টল নামের উৎপত্তি
চট্টগ্রামের হিন্দু সমাজে একসময় কুলীন ব্রাহ্মণদের বাস ছিল, যাদের মধ্যে চট্টোপাধ্যায় পদবীর আধিক্য দেখা যায়। তাদের প্রভাবেই এই অঞ্চলের নাম “চট্টল” বা “চট্টলা” হয়ে যায়। প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রেও চট্টগ্রামের উল্লেখ “চট্টল” নামে পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে চীনা পরিব্রাজক হিউয়াং-সাং চট্টগ্রামকে “শ্রী চট্টল” বলে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও হিন্দু পুরাণ এবং যোগিনী তন্ত্রেও “চট্টল” নামের উল্লেখ পাওয়া যায়।
আরাকানবাসীদের দেওয়া “রোসাঙ্গ” নাম
চট্টগ্রামের ইতিহাসে আরেকটি উল্লেখযোগ্য নাম হলো “রোসাঙ্গ”। কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্ব তীর থেকে নাফ নদীর উত্তর তীর পর্যন্ত এ অঞ্চল “রোসাঙ্গ” নামে পরিচিত ছিল। মধ্যযুগে চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এবং আরাকানিরা একে “আনক”, “আনফ” বা “পশ্চিম দেশ” হিসেবে চিনত। আরাকানের রাজধানী “ম্রোহাং”-এর বিকৃত উচ্চারণ থেকে চট্টগ্রামের এ নামটি এসেছে।
“ফতেয়াবাদ”, “ইসলামাবাদ” ও পরবর্তী নামকরণ
চট্টগ্রামের নাম নিয়ে পরিবর্তন এসেছে শায়েস্তা খানের আমলেও। ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম অধিকার করার পর মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে তিনি চট্টগ্রামের নাম রাখেন “ইসলামাবাদ”। পর্তুগিজ বণিকদের কাছে এটি পরিচিত ছিল “পোর্টো গ্রান্ডে” নামে। তাদের বানিজ্যিক কার্যক্রমকে সহজ করার জন্য কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে তারা আলো জ্বালাতো। এই আলো থেকেই চট্টগ্রামের আরেক নাম “চাটিগ্রাম” বলে বিবেচনা করা হয়।
আজকের চট্টগ্রাম: একটি ঐতিহ্যের প্রতীক
চট্টগ্রামের নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক গল্প। লিখিত ইতিহাস অনুসারে, এ জনপদের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় গ্রিক ভূগোলবিদ প্লিনির “পেরিপ্লাস” বইয়ে। ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন এ জনপদটি তার বৈচিত্র্যময় নাম, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে।
চট্টগ্রাম শুধু একটি শহর নয়; এটি বাঙালি সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য এবং ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতীক। আজও এর নামের উৎপত্তি নিয়ে নানা মতামত থাকলেও একথা নিশ্চিত যে, চট্টগ্রাম একটি ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল, যা অতীতের নানা দুঃসাহসিক গল্প আর বৈচিত্র্যময় ইতিহাসকে ধারণ করে রেখেছে।
চট্টগ্রাম: ইতিহাসের ধারায় নানা আক্রমণ ও নামের পরিবর্তন
চট্টগ্রামের ইতিহাসকে দেখলে বারবার চোখে পড়ে নানা শক্তি ও শাসকের আগমন, যারা বারবার এ জনপদকে নিজেদের অধীনে আনতে চেয়েছে। এটি মূলত একটি কৌশলগত ও অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হওয়ায় বহিরাগতদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিল। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশের বণিকদের আগমন ঘটেছে এখানে, যা এ অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে পরিণত করেছিল।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ হিসেবে পরিচিত হওয়ায় আরব, পারস্য, চীন ও ইউরোপীয় বণিকরা চট্টগ্রামের দিকে আকৃষ্ট হন। তাদের প্রতিক্রিয়া ও বিবরণ থেকে দেখা যায়, প্রত্যেকটি জাতির এ জনপদকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকতে অভ্যস্ত ছিল, যা চট্টগ্রামের নামকরণের বিচিত্র ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গৌড়ের সুলতানগণ এ জনপদকে নতুন নতুন নাম দিয়েছেন, যেমন, নুসরত শাহ ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জয় করে এ শহরের নাম দেন “ফদহ-ই-আবাদ” বা “ফতেয়াবাদ”।
ইসলামিক শাসনের অধীনে চট্টগ্রাম এবং “ইসলামাবাদ” নামের উৎপত্তি
মুঘল আমলে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান চট্টগ্রামকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আনেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে তখন এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় “ইসলামাবাদ”। যদিও পরবর্তীতে এ নামটি বেশিদিন জনপ্রিয় হয়ে থাকেনি, তবুও তা ইতিহাসের পাতায় আজও স্মরণীয় হয়ে রয়েছে। “ইসলামাবাদ” নামটি চট্টগ্রামের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছিল, যা তার আধ্যাত্মিক পরিচয়ের একটি অংশ হয়ে রয়েছে।
পর্তুগিজদের আগমন এবং “পোর্টো গ্রান্ডে”
প্রায় ১৬শ শতাব্দীতে চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের আগমন ঘটে। বাণিজ্যের সুবিধার জন্য তারা কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বসতি গড়ে তুলে এবং এখানকার পর্বতের উপরে চাটি বা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখত। গভীর সমুদ্র থেকে এসব প্রদীপের আলো দেখা যেত বলে অনেকেই মনে করেন “চাটিগ্রাম” নামটি এখান থেকেই এসেছে।
পর্তুগিজ বণিকদের কাছে চট্টগ্রাম ছিল “পোর্টো গ্রান্ডে” নামে পরিচিত, যা তাদের কাছে একটি বৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। পর্তুগিজদের প্রভাব এ জনপদের বাণিজ্য ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে তুলেছিল এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামের ইতিহাসে তাদেরও অবদান রাখার সাক্ষ্য রেখে গেছে।
ইবনে বতুতার চট্টগ্রাম সফর এবং নামের ভিন্নতা
১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা চট্টগ্রামে এসেছিলেন। তার ভ্রমণ কাহিনিতে চট্টগ্রামকে তিনি “সোদকাওয়ান” বা “সতের কাউন” নামে উল্লেখ করেছেন। এ নামটি আজকের চট্টগ্রামের জন্য সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী হলেও, এটি তার ভ্রমণ কাহিনিতে এ অঞ্চলের বর্ণনাকে তুলে ধরে। চট্টগ্রামের ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যটক ও পরিব্রাজকরা এ শহরের নানা রূপ ও ঐতিহ্যের বর্ণনা করেছেন, যার মধ্যে ইবনে বতুতার কাহিনিও আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
হোসেন শাহ ও তার পুত্র নুসরত শাহের শাসনকালে চট্টগ্রামের পরিচিতি
গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহের শাসনামলে তার পুত্র নুসরত শাহ চট্টগ্রাম জয় করেন এবং এর নাম দেন “ফদহ-ই-আবাদ”, যা পরবর্তীতে “ফতেয়াবাদ” নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। হোসেন শাহের আমলে চট্টগ্রামের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। সুলতান নুসরত শাহ তার শাসনামলে এ অঞ্চলে বিভিন্ন স্থাপত্য নির্মাণ করেন এবং চট্টগ্রামের বাণিজ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেন। তার এ অবদান চট্টগ্রামকে আরও সমৃদ্ধশালী বানায় এবং এর পরিচিতি আরও বিস্তৃত হয়।
ব্রিটিশ শাসনের আগমনের পর চট্টগ্রামের “চিটাগাং” নামকরণ
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়ের পর ব্রিটিশরা ধীরে ধীরে সমগ্র বাংলাকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। তারা চট্টগ্রামের কৌশলগত ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব বুঝতে পেরে এ অঞ্চলে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। ব্রিটিশদের শাসনামলে চট্টগ্রামের নাম ইংরেজিতে “চিটাগাং” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এ নামটি প্রথমে স্থানীয়দের কাছে জনপ্রিয়তা না পেলেও, ধীরে ধীরে প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কাজকর্মের মাধ্যমে এ নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশ শাসনামলে চট্টগ্রাম বন্দর আরও উন্নত হয় এবং এ অঞ্চলটি বাণিজ্যিকভাবে সমৃদ্ধি লাভ করে। ব্রিটিশরা এখানকার বিভিন্ন পণ্য, যেমন চা, কাঠ ও পাট রপ্তানি করত, যা তাদের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎসে পরিণত হয়।
আধুনিক চট্টগ্রাম এবং তার প্রাসঙ্গিকতা
আজকের চট্টগ্রাম আর শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক জনপদ নয়; এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি। চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি বিশাল পরিমাণ বৈদেশিক বাণিজ্য পরিচালিত হয়। এ অঞ্চলের শিল্প-কারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলছে।
চট্টগ্রামের ইতিহাস শুধু এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বন্দর কেন্দ্রিক নয়, এটি একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক। বর্তমানে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সেরা পর্যটন কেন্দ্রগুলোর একটি, যা প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটককে আকর্ষণ করে।
চট্টগ্রামের নামকরণ: এক চিরস্থায়ী রহস্য
চট্টগ্রামের নামকরণ নিয়ে এত বিতর্ক রয়েছে যে একে কোনো একক অর্থ দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। গবেষকদের মতে, চট্টগ্রামের নামকরণের পিছনে বহু আঞ্চলিক এবং বহিরাগত প্রভাব কাজ করেছে। গ্রিক, আরব, পারস্য, ভারতীয় এবং ব্রিটিশ ভ্রমণকারী ও শাসকদের দ্বারা এই নামের বিবর্তন ঘটেছে, যা তার ইতিহাসকে একটি চিরস্থায়ী রহস্যে পরিণত করেছে।
চট্টগ্রামের এতগুলো নামের বৈচিত্র্য দেখলে বোঝা যায়, এটি কেবল একটি শহর নয় বরং একটি জীবন্ত ঐতিহাসিক উপাখ্যান, যেখানে প্রতি যুগে যোগ হয়েছে নতুন গল্প, নতুন পরিচয়।
চট্টগ্রামকে তাই বলা যায় এক মহাকাব্যিক শহর, যার ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং নামের বিবর্তন তার প্রাচীন বৈচিত্র্যময়তার প্রতীক।