বর্তমান বাংলাদেশে মেধাবী তরুণ সমাজের একটি বড় অংশের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। উন্নত জীবনের আশায় কিংবা উচ্চশিক্ষা ও কাজের জন্য দেশ ছাড়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে শুধু বিদেশ যাত্রা নয়, এদের অনেকেই দেশের বাইরে স্থায়ী হতে চাইছে, যা একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি করছে।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের সাম্প্রতিক এক গবেষণা, যার শিরোনাম ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ’, এই পরিস্থিতিকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে দেশের ৫৫ শতাংশ তরুণ পড়াশোনা ও কাজের উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে যেতে আগ্রহী। তরুণদের এই বিদেশমুখী হওয়ার কারণ সম্পর্কে গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে উচ্চ বেকারত্ব এবং কর্মসংস্থানের অভাবই এর মূল কারণ। এছাড়া দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগে বৈষম্য এবং জীবনের ভারসাম্যহীনতাও এই প্রবণতায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
যদি মেধাবী শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যায় এবং পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরে এসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখে, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু সমস্যা তখনই দেখা দেয় যখন তারা বিদেশে গিয়ে আর দেশে ফিরে আসে না। এটি দেশের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, যাকে ‘মেধা পাচার’ বলা হয়। এই মেধা পাচার আমাদের জাতীয় উন্নয়নের পথে একটি বড় বাঁধা সৃষ্টি করছে। তবে প্রশ্ন হলো, তরুণরা কেন দেশে না থেকে বিদেশমুখী হচ্ছে? শুধু উচ্চ বেকারত্ব নয়, আরও নানা কারণ এর পেছনে কাজ করছে।
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতাগুলো তরুণদের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের দেশে এখনও উচ্চশিক্ষার মান উন্নত দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা উন্নত শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য বিদেশের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। তারা উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফেরার পরিবর্তে বিদেশে থেকে আরও ভালো জীবনযাত্রা এবং কাজের সুযোগ পছন্দ করছে। এর ফলে একদিকে যেমন দেশ হারাচ্ছে তার মেধাবী প্রজন্মকে, অন্যদিকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এই মেধা পাচারের কারণ অনুসন্ধান করলে কয়েকটি মূল কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমত, দেশের কর্মসংস্থানের অভাব এবং চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতার চাপ। দেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। এছাড়া, যারা চাকরির সুযোগ পায়, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পেশা বা উপযুক্ত বেতন পান না। বেকারত্বের পাশাপাশি নিয়োগে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতির প্রবণতাও কর্মসংস্থানের সুযোগকে সংকুচিত করছে। ফলে তরুণরা মনে করছে যে, তাদের যোগ্যতা এবং মেধা দেশে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোর চাকরি বাজার তরুণদের কাছে আরও নিরাপদ এবং আকর্ষণীয় মনে হয়। সেখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি পাওয়া সম্ভব হয় এবং সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে কর্মজীবনে অগ্রগতি সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, উন্নত জীবনযাত্রা, উচ্চ আয় এবং নিরাপদ ভবিষ্যতের আশায় তরুণদের মধ্যে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। উন্নত দেশগুলোর জীবনের মান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সামাজিক নিরাপত্তার চিত্র আমাদের দেশের তুলনায় অনেক উন্নত। এদেশের তরুণরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, বিশেষত যখন তারা মনে করে যে, বিদেশে তারা তাদের প্রতিভা এবং কর্মদক্ষতা আরও ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারবে। শিক্ষার মানের দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং তাদের গবেষণার সুযোগ-সুবিধা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে। ফলে তারা মনে করে, বিদেশে তারা তাদের স্বপ্নপূরণ এবং ক্যারিয়ার গড়তে আরও ভালো সুযোগ পাবে।
এছাড়া, আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নয়ন এবং শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনেক ঘাটতি রয়েছে। শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার জন্য পর্যাপ্ত গবেষণা সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই। ফলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে চাইলেও অনেকেই মনে করে, তারা তেমন কোনো সুবিধা পাবে না। শুধু একাডেমিক শিক্ষা নয়, উচ্চশিক্ষার পাশাপাশি কর্মজীবনে প্রযোজ্য বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সীমাবদ্ধ।
দেশের তরুণদের বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা কমানোর জন্য করণীয় হিসেবে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রথমত, উচ্চশিক্ষা এবং গবেষণার মান উন্নত করতে হবে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো এখানে গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা হলে তরুণরা বিদেশমুখী হওয়ার পরিবর্তে দেশেই থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হবে। দ্বিতীয়ত, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মতো সমস্যা সমাধানে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু চাকরির সংখ্যা বাড়ালেই হবে না, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগের নিশ্চয়তা দিতে হবে এবং তরুণদের শিক্ষা ও দক্ষতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশে যদি একটি দক্ষ এবং স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থা তৈরি করা যায়, তবে তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম এবং দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে সরকারকে তরুণদের জন্য একটি সুষ্ঠু কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যা দেশের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সমর্থন করবে। তাছাড়া, দেশে চাকরির বাজারে বেতন ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে উন্নয়ন আনতে হবে। তরুণরা যদি মনে করে, দেশে থেকেও তারা একটি সম্মানজনক ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে, তবে তাদের মধ্যে বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে।
এছাড়া, উন্নত দেশগুলোতে যে সমস্ত তরুণ উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে, তাদেরও দেশে ফিরে আসার জন্য উদ্দীপনা তৈরি করতে হবে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তরুণরা দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী হয়, যদি তারা দেখতে পায় দেশে তাদের প্রতিভা এবং জ্ঞানকে কাজে লাগানোর জন্য যথাযথ পরিবেশ রয়েছে। এক্ষেত্রে দেশে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্তদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি এবং সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে। এতে করে দেশে আরও দক্ষ এবং শিক্ষিত তরুণ সমাজ গড়ে উঠবে এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
সবশেষে, আমাদের দেশের তরুণদের বিদেশমুখী হওয়ার এই প্রবণতা রোধ করতে হলে কেবল একটি খাত নয়, বরং সার্বিক উন্নয়ন প্রয়োজন। তরুণদের জন্য একটি স্থিতিশীল, নিরাপদ, এবং মানসম্পন্ন কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থান এবং কর্মক্ষেত্রে বেতন-ভাতা সংক্রান্ত যে সকল সমস্যার কারণে তরুণরা বিদেশমুখী হচ্ছে, তা সমাধান করতে পারলে তরুণ সমাজের এই মেধা পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। তরুণদের কাছে একটি সমৃদ্ধ এবং সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারলে, তারা দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে আগ্রহী হবে। তরুণদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন এবং তাদের মেধাকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দিতে পারলে, দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং ভবিষ্যতে একটি শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে।