কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপে ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র এখন সম্পূর্ণ অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দেশের প্রথম ও বৃহত্তম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রের এমন পরিণতি জনমনে হতাশা সৃষ্টি করেছে। একসময় এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দ্বীপের মানুষের জীবনে আলোকিত সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ তা শুধুই পরিত্যক্ত স্থাপনা ও মরিচা ধরা যন্ত্রাংশে পরিণত হয়েছে।
অঞ্চলটির উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে সরকারের এই উদ্যোগ সফল হতে পারেনি। স্থানীয় বাসিন্দারা এবং বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পটির ব্যর্থতার জন্য দুর্নীতি, তদারকির অভাব এবং স্থান নির্বাচনে অদূরদর্শিতাকে দায়ী করছেন। এমনকি বর্তমানে প্রকল্পটির অব্যবস্থাপনার কারণে এটি এলাকাবাসীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথম প্রকল্প: স্বপ্নের শুরু, হতাশার শেষ
২০০৭ সালে আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের তাবলেরচর এলাকায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ১ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। কেন্দ্রটির জন্য ৫০ ফুট উঁচু ৫০টি বায়ুকল স্থাপন করা হয়েছিল, যেগুলোর মাথায় বসানো হয়েছিল ইস্পাতের উইন্ড টারবাইন। কেন্দ্রটির পরিকল্পনা ছিল বাতাসের সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা ব্যাটারিতে জমা করে স্থানীয় গ্রাহকদের সরবরাহ করা।
২০০৮ সালের ১৫ মার্চ কেন্দ্রটি পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হয় এবং ১৪ এপ্রিল ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে সান্ধ্যকালীন কয়েক ঘণ্টার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই যন্ত্রাংশ অচল হয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কেন্দ্রটি ঝুঁকির মুখে পড়ে। গত ১৬ বছরে এ প্রকল্পটি আর কার্যকর হয়নি।
দ্বিতীয় প্রকল্প: আরও ব্যয়বহুল, একই পরিণতি
প্রথম প্রকল্প অকার্যকর হওয়ার পর ২০১৬ সালে এর পাশেই আরও একটি নতুন বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ২৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই কেন্দ্রটিও ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে তৈরি করা হয়। ২০১৮ সালের ১৫ মার্চ এটি চালু হয় এবং ৩৫০ জন গ্রাহকের কাছে সন্ধ্যাকালীন বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়। তবে মাত্র এক মাসের মধ্যেই এটি অচল হয়ে পড়ে।
বর্তমানে কেন্দ্রটির ভবনে তালা ঝুলছে, আর লোনা হাওয়ার কারণে বায়ুকলগুলো মরিচা ধরে গেছে। খুঁটির মাথার পাখাগুলো ভেঙে পড়েছে এবং মূল্যবান যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে গেছে। প্রকল্পটি এখন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
অযত্নে নষ্ট হচ্ছে সম্পদ
১২ ও ১৩ নভেম্বর কুতুবদিয়া পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি একেবারে অযত্নে পড়ে রয়েছে। ২০০৭ সালে নির্মিত প্রথম কেন্দ্রটির ভবন এবং যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। কেন্দ্রটির ব্যাটারি ও মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। দ্বিতীয় কেন্দ্রটিরও একই অবস্থা। গেটের তালা ভেঙে ভবনের ভেতরে থাকা মূল্যবান যন্ত্রপাতি চুরি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। অরক্ষিত জমিতে চলছে লবণ উৎপাদন।
আলী আকবর ডেইল ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ খান বলেন, “দুর্নীতি, তদারকির অভাব এবং স্থান নির্বাচনে ভুলের কারণে এ প্রকল্প সফল হয়নি। বাইরের মানুষের কাছে এটি বিনোদনকেন্দ্র হলেও আমাদের জন্য বোঝা।”
জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ: নতুন সম্ভাবনার দ্বার
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল কুতুবদিয়া জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সুবিধা পায়। সাবমেরিন কেব্লের মাধ্যমে পেকুয়া থেকে সংযোগ নিয়ে ৯ হাজার ৭০০ গ্রাহক এখন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন। বর্তমানে উপজেলার বিদ্যুতের চাহিদা ২.৫ মেগাওয়াট, যা শতভাগ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে দ্বীপে লোডশেডিং নেই।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আদিল চৌধুরী বলেন, “জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ আসার ফলে দ্বীপের অর্থনীতিতে গতি এসেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হয়েছে। চাষাবাদ, পোলট্রি, মৎস্য খামারসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে। আগে যেখানে সবকিছু স্থবির ছিল, এখন সেই পরিস্থিতি পাল্টে গেছে।”
স্থানীয়দের দাবি: প্রকল্পের জবাবদিহি প্রয়োজন
বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটির ব্যর্থতার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা সরাসরি সরকারের তদারকির অভাব এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্নীতিকে দায়ী করছেন। প্রকল্পগুলো পুনরুজ্জীবিত করার কোনো পরিকল্পনা না থাকায় এগুলো এখন একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কুতুবদিয়া আবাসিক প্রকৌশলী সুভাষ চৌধুরী বলেন, “কেন্দ্র দুটি এখনও পিডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। তাই কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”
বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী মনছুর আলম ও একরামুল হক কেন্দ্রটি পরিদর্শন করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, “এভাবে জনগণের টাকার অপচয় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের উচিত এ ধরনের প্রকল্পের বিষয়ে জবাবদিহি নিশ্চিত করা।”
কুতুবদিয়ার বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প দুটি আজ ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ দ্বীপের জীবনমান বদলে দিচ্ছে, সেখানে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের ব্যর্থতা সরকারের তদারকি ও নীতিগত দুর্বলতারই প্রতিফলন। স্থানীয় বাসিন্দারা চান, ভবিষ্যতে এমন কোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে সঠিক পরিকল্পনা এবং যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করা হোক। জনগণের করের টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।