শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন সাইকা আসমা সানমুন। গত রোববার সন্ধ্যায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সমাপনী বর্ষের ফলাফল প্রকাশিত হলে তার এই সাফল্যের কথা সকলের নজরে আসে।
চট্টগ্রাম নগরীর সরকারি মহিলা কলেজের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী সাইকা আসমা সানমুন ৩৬ ইঞ্চি উচ্চতার। ২৫ বছর বয়সী এই তরুণী অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর মনের জোরে সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এই সাফল্য অর্জন করেছেন। তার এই সাফল্যে আসমার পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী এবং কলেজের শিক্ষকমণ্ডলী অনেক খুশি।
ফটিকছড়ি উপজেলা পরিষদের পূর্ব পাশে প্রফুল্ল ডাক্তার বাড়িতে আসমার বাস। তার বাবা আবু সালেহ চৌধুরী একজন ব্যবসায়ী এবং মা মাজেদা বেগম তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।
মেয়ে সাইকা আসমা সানমুনের সাফল্যের কথা জানতে চাইলে মা মাজেদা বেগম বলেন, “ওর এই যাত্রা মোটেও সহজ ছিল না। আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠেনি সে। এই সবকিছুর জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে আমাদের। আগে ইচ্ছা ছিল তার পড়াশোনা শেষ করানো আর এখন একমাত্র ইচ্ছা মেয়ের একটা ভালো চাকরি হোক। আমাদের অবর্তমানে সে যেন নিজেকে নিজে চালিয়ে নেয়ার সক্ষমতা অর্জন করে।” অনেকে আড়ালে হাসি-ঠাট্টা করেন বলেও তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করেন।
সাইকা আসমা সানমুন বলেন, “এই অনার্স ডিগ্রি অর্জনের পেছনে আমার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন আমার মা-বাবা। তারা আমার বেঁচে থাকার শক্তি। শত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে আমার মা-বাবার অনুপ্রেরণায় আমি এতদূর আসতে পেরেছি। প্রচুর সমস্যাকে দূরে রেখে আমার মা-বাবা আমার পড়াশোনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে গ্রাম ছেড়ে অচেনা ব্যস্ত নগরীতে আমি উচ্চ শিক্ষার জন্য যেতে পেরেছিলাম। আমার বাবা আমার পড়াশোনার জন্য এতটাই সহযোগিতা করেছেন যে, মাকে বাসার সকল কাজ ফেলে আমাকে কলেজে আনা নেয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। যেখানে কখনো বাবাকে ছাড়া এলাকার বাহিরেও যাওয়া হতো না, সেই অবস্থায় আমি আর আমার মা কলেজে যাতায়াতের জন্য চট্টগ্রাম শহরে একা একা যাতায়াত করেছি।”
“জীবিকার তাগিদে বাবা আমাদের সাথে থাকতে না পারলেও আমার বাবার পূর্ণ সহযোগিতা আমার শক্তি। কলেজে আসা-যাওয়ায় আমাদের প্রায়ই ১২ ঘণ্টা লেগে যেত। সকাল ৬টায় বের হলে রাত ৯টায় বাসায় ফিরতাম। আমি ক্লাস এবং পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও আমার মা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করতেন।”
“আমার সহপাঠীরা আমাকে বলত, ‘আন্টি যে তোমাকে নিয়ে এভাবে সারাদিনের জন্য চলে আসে, বাসার কাজ কে করে?’ আসল বিষয়টা হল – বাসার সকল কাজ শেষ করে মা আমাকে নিয়ে কলেজে আসত, আবার বাসায় ফিরে বাকি সব কাজ করত। শত পরিশ্রমের পরও আমার মায়ের চোখে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি ছিল না। আমার স্বপ্নময়ী মা। আমার এই সাফল্য আমার নয়, আমার মা-বাবার।”
সাইকা আসমা সানমুন দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “আমাদের মতো শারীরিক প্রতিবন্ধীদের সমাজে নীচু চোখে দেখা হয়। শিক্ষিত মানুষেরা এটি আরও বেশি করে। কেন আমার মধ্যে কি এমন আছে যে এভাবে দেখতে হবে? আমরা যারা শিক্ষিত হয়েছি সরকার যেন তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করে। আর যারা শয্যাশায়ী শারীরিক প্রতিবন্ধী আছে তাদেরকে আমাদের দেওয়া ভাতা দেওয়া হোক। আমি বলছি না আমাকে ক্যাডার হতে হবে, আমার যে সীমাবদ্ধতা আছে তার ভেতর থেকেই তো কাজ করতে পারি। তাও অনেকে বলে আপনার সাথে কাজ করতে আমাদের সমস্যা হবে।”
সাইকা আসমা সানমুনের ভাবী ফারহানা বলেন, “আমরা দেখেছি কি পরিমাণ কষ্ট ত্যাগ স্বীকার করে সাইকার বাবা-মা তাকে বড় করেছে। আজকে এই পর্যন্ত আসার পেছনে তাদের অবদান অনেক। নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তো আছেই, তাকে এই সাফল্য লাভের জন্য অগ্রাহ্য করতে হয়েছে সমাজের নানা রকম প্রতিবন্ধকতাকেও। আমরা অনেক সময় তাকে নিয়ে বের হলে লোকজনকে নানা রকম কটূ মন্তব্য করতে দেখেছি। এটা দেখে মানুষ হিসেবে আমরাও লজ্জিত হতাম। সাইকা স্নাতক পাস করেছে, এখন আশা তার যেন একটা ভালো চাকরি হয়।”