সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদলিড‘ও-রে আমার বা-জান, তুই আমারে ছাইরা কই গেলি’

‘ও-রে আমার বা-জান, তুই আমারে ছাইরা কই গেলি’

ভোলা প্রতিবেদক

ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া গ্রামের এক মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ শোনে পুরো জনপদ স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রতিদিনই কাঁদতে কাঁদতে ছেলের কবরের কাছে ছুটে যান জিন্নাতুন নেছা, সেই কবর যেখানে ঘুমিয়ে আছে তার আদরের ছেলে মো. দেলোয়ার হোসেন। তাঁর কান্নার সাথে মিলেমিশে থাকছে এক মায়ের নিঃস্ব জীবনের চিত্র।

৬৯ বছর বয়সী জিন্নাতুন নেছা তাঁর সন্তান দেলোয়ারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাঁদছেন। শোকে বিধ্বস্ত হয়ে বার বার কবরের কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তিনি। চোখের জল আর হৃদয়ের ব্যথা সহ্য করতে না পেরে কখনও কাঁদছেন, কখনও আবার মাটিতে হোঁচট খেয়ে পড়ছেন।

গত ২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন দেলোয়ার। মৃত্যু পরবর্তী আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও এই বুড়ি মা একটিও দিন শান্তি পায়নি। ছেলের স্মৃতি, তার হাসি, তার কথা—সবকিছুই যেন এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে, তবে বেঁচে আছে তার একমাত্র আহাজারি, যা প্রতিদিনই কাচিয়া গ্রাম ছড়িয়ে পড়ে।

দেলোয়ার ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। পাঁচ ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল, আর তাই বৃদ্ধ মা জিন্নাতুন নেছা তার সঙ্গেই ঢাকায় থাকতেন। তাঁর স্বামীও ছিলেন না, তাই দেলোয়ারের কাছেই সবার জীবন চলত। ঢাকায় থাকতেন, খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসা—সব কিছুই চলত দেলোয়ারের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখন তার মৃত্যুতে সব কিছু ভেঙে গেছে।

বর্তমানে মা জিন্নাতুন নেছা তার অপর ছেলে আনোয়ারের কাছে থাকছেন, যিনি দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন। অথচ সেই ছেলে যেন তাঁর জন্য কিছুই করতে পারে না, মা চিকিৎসা থেকে শুরু করে বেসিক জীবনধারণের জন্য কিছুতেই পারছেন না।

দেলোয়ারের চিকিৎসা খরচের ভার ছিল প্রায় চার লাখ টাকা, যা পুরোপুরি ঋণ নিয়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেই ঋণের বোঝা এখন পরিবারে রয়ে গেছে, এবং কোনোভাবে সেসব টাকা পরিশোধের চেষ্টা চলছে। তবে দেলোয়ারের স্ত্রী লিজা বেগম বলেছেন, “এখন যে ঋণ আমার স্বামীর চিকিৎসায় ব্যয় করা হয়েছে, সেটা কীভাবে পরিশোধ করব, বুঝে উঠতে পারছি না।”

মিরপুর ১০ নম্বরে গুলির আঘাতে মৃত্যুর মুখে পতিত দেলোয়ারের চিকিৎসার জন্য তাদের যে ঋণের বোঝা বেড়ে গেছে, তা এখন পরিবারের পক্ষে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। লিজা বেগম এখন সংসারের হাল ধরতে ও ঋণের বোঝা পরিশোধ করতে বিপদে পড়েছেন। তাদের ১৩ বছর বয়সী ছেলে রাব্বি হাসান, ৬ বছর বয়সী মেয়ে হাসনুর এবং ১৮ মাস বয়সী ছেলে হোসাইন—এই তিন সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিতে তাকে নানা দুশ্চিন্তায় ভুগতে হচ্ছে।

এদিকে, নিহত দেলোয়ারের মা জিন্নাতুন নেছার কান্না থামছেই না। তিনি বলেন, “আমার ছেলেকে কেন মেরে ফেলল? সে তো খুবই ভালো মানুষ ছিল। ওর সাথে আমি এতগুলো বছর কাটিয়েছি। এখন কে আমাকে চিকিৎসা দিবে? কার কাছে থাকব আমি?” তাঁর স্বামীও ছিলেন না, আর পাঁচ ছেলে সবাই তাদের মতই কষ্টে দিনাতিপাত করে। দেলোয়ারই ছিল একমাত্র যার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন তিনি।

এখন, এই শোকের সাগরে ভাসতে থাকা মায়ের একটাই আকুতি—তিনি চান, ‘আমি মৃত্যুর আগে অন্তত আমার ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে চাই।’

এই বিভাগের আরও পড়ুন