সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদটপ নিউজবেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি শিক্ষার নামে ব্যবসা করছে?

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি শিক্ষার নামে ব্যবসা করছে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

সরকার এখনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব, মামলা, সনদবাণিজ্যসহ নানা অভিযোগে জর্জরিত। বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখার উপযুক্ত পরিবেশ নেই।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অনুমোদন পাওয়া অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে সংকটগ্রস্ত। এসব সমস্যাগ্রস্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যাপক সনদ বাণিজ্যের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ইউজিসিতে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) সনদ যাচাইয়ের অনুরোধ আসছে।

বাংলাদেশে বর্তমানে ১১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও, কেবল ১০৬টিতে শিক্ষাকার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর মধ্যে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি একটি অনন্য উদাহরণ। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারায় ২০০৬ সালে সরকার এটি বন্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আদালতের রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি পুনরায় চালুর অনুমতি পায়।

তবে, বর্তমানে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির কোনো অনুমোদিত ক্যাম্পাস নেই এবং আইনগতভাবে এর অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। শুধুমাত্র রাজধানীর বারিধারায় একটি ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাইনবোর্ড দেখা যায়, যা অতীতের স্মৃতি বহন করে।

সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের সময়ে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগামহীন কার্যকলাপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় দখল হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম তদন্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় অবাধে চলেছে এবং আত্মীয়করণের কারণে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে।

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ক্লাস না নিয়ে পরীক্ষা নেওয়া, নির্ধারিত সময়ের আগে কোর্স শেষ করা সহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয়, যা আওয়ামী লীগের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে অনুমোদন পেয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে, বর্তমানে ট্রাস্টিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে সংকটের মুখে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান অভিযোগ করেছেন যে, সাবেক ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আহমদ আওয়ামী লীগের প্রভাব ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে এ মুহূর্তে বেশ কয়েকটি মামলা চলমান রয়েছে এবং সম্প্রতি তাকে ট্রাস্টি বোর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।

মুজিবুর রহমান দাবি করেছেন যে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সুষ্ঠু একাডেমিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

ইবাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হওয়ায় এর আইনগত ভিত্তি বর্তমানে অস্তিত্বহীন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা ইউজিসির অনেক কর্মকর্তা এই অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে চাকরি করছেন এবং পদোন্নতির অপেক্ষায় রয়েছেন। একইভাবে, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার ও সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে, ফলে এর কার্যক্রমের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। ইউজিসি কর্মকর্তাদের মতে, এসব বিশ্ববিদ্যালয় অনেক জাল সনদ বিতরণ করেছে।

ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষাকার্যক্রম স্থানান্তর করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রেখেছে সরকার। সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ও সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বোর্ড অব ট্রাস্ট নিয়ে জটিলতা, দ্বন্দ্ব ও মামলায় জর্জরিত। গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে এখানে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রয়েছে।

সাউদার্ন ইউনিভার্সিটিতে আর্থিক, একাডেমিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত চলছে এবং এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে একাধিক মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠার পর থেকে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত কোনো ট্রেজারার নেই। কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে বন্ধ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ এস এম ফায়েজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিয়ম মেনে চলছে এবং শিক্ষার মান বজায় রাখছে।

তবে, একই সাথে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হতে পারে না।

অধ্যাপক ফায়েজ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আইন না মেনে যেনতেনভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে দেওয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন নিয়মের মধ্যে পরিচালিত হয় সে ব্যাপারে কমিশন সব ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তিনি কারও বিরুদ্ধে কঠোর হতে না চাইলেও, নীতির ব্যাপারে অটল থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও পড়ুন