সময়টা ১৯২০ সাল। সমগ্র ভারতবর্ষের মতো তখন চট্টগ্রামও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অগ্নিমুখী হয়ে উঠেছে। প্রতিটি শহর আর গ্রামে দেখা মিলছে স্বাধীনতার জন্য আগুন জ্বালানো উৎসুক বিপ্লবীদের। তাদের দৃঢ় সংকল্প আর স্বাধীনতা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ক্রমেই ব্রিটিশ শাসকদের কাঁপিয়ে তুলছে। তেমনই সময়ে বিপ্লবীদের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামের একটি ছোট্ট মিষ্টির দোকান — বোস ব্রাদার্স।
তবে বোস ব্রাদার্স শুধু একটি মিষ্টির দোকান নয়, বরং ইতিহাসের সাক্ষী, বিপ্লবের সহযাত্রী এবং বাঙালির আত্মত্যাগের অনন্য উদাহরণ। চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকার নন্দনকানন চৌরাস্তার মোড়ে অবস্থিত এই দোকানটি এখনো মিষ্টির ঐতিহ্য বহন করছে।
শুরুটা যেভাবে: চট্টগ্রামে বোস পরিবারের যাত্রা
প্রায় দুই শতাব্দী আগে, ব্রিটিশ শাসনের অযৌক্তিক নীতি এবং দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বাঙালি জনজীবনে এক অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ১৭৭০ সালের মহাদুর্ভিক্ষের ফলে বিপর্যস্ত বাংলার জনগণ জীবিকার তাগিদে ছুটে চলতে বাধ্য হয় নানা স্থানে। এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার গুনডাইক্কা গ্রামের অধিবাসী সারদা চরণ বোস তার স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে এসে স্থায়ী হন চট্টগ্রামের আনোয়ারা অঞ্চলে।
সারদা চরণ পেশা হিসেবে বেছে নেন মিষ্টি বানানোর কাজ। ছোটো ছোটো মিষ্টির চালান নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় পায়ে হেঁটে বিক্রি করতেন তিনি ও তার ভাই আনন্দ বোস। দুই ভাইয়ের পরিশ্রম আর মিষ্টির গুণে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে এই ব্যবসা। একসময় মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বোস পরিবারের মিষ্টির সুনাম। এরপর তাদের ছোট মিষ্টির ব্যবসাকে বড় পরিসরে পরিচালনার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন সারদা চরণ ও তার ছেলে শুধাংশু বিমল বোস। এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালে শুরু হয় ‘বোস ব্রাদার্স’ দোকানের যাত্রা।
শুধাংশু বিমল বোস: সশস্ত্র বিপ্লবী ও মিষ্টির কারিগর
শুধাংশু বিমল বোস ছিলেন তার পিতার মতোই একজন প্রতিভাবান মিষ্টির কারিগর। তবে কেবল মিষ্টির কারিগরই নয়, তিনি ছিলেন একজন অকুতোভয় স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র বিপ্লবীও। তার জীবন জুড়ে ছিল ব্রিটিশ শাসনের প্রতি গভীর বিদ্বেষ, যা তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে তাড়িত করেছিল। সুদূর ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সচেতন। ১৯২৩ সালে গঠিত স্বরাজ দলের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি এবং নিজেকে ‘স্বরাজী’ বলে পরিচয় দিতেন।
বোস ব্রাদার্স: বিপ্লবীদের গোপন বৈঠকের কেন্দ্রবিন্দু
চট্টগ্রামের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল বোস ব্রাদার্স। বিভিন্ন সময়কার সংগ্রামের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের বৈঠক এই দোকানেই চলত। সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এবং কল্পনা দত্তের মতো বিপ্লবীরা নিয়মিত আসতেন এখানে। চায়ের টেবিলে মিষ্টি ও নাস্তার সাথে ক্রমশ জমে উঠত বিপ্লবের আড্ডা। স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার স্বপ্নে তারা ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতেন। ইংরেজদের উপর আঘাত হানার ছক তৈরিতে এই দোকানই হয়ে উঠেছিল অন্যতম স্থান।
এসময় শুধাংশু বিমল বোস কেবল একজন মিষ্টি বিক্রেতা নন, বরং একজন বিপ্লবীর ভূমিকায়ও নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন। সূর্য সেনের নেতৃত্বে জালালাবাদ বিদ্রোহে অংশগ্রহণ এবং পরবর্তীতে ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের মতো গুরুতর অভিযানে তিনি সামিল হন। নিজের দোকানকেই তিনি বানিয়েছিলেন এইসব বিপ্লবীদের গোপন মিলনস্থল। এখানেই গড়ে উঠেছিল এক অসাধারণ একাত্মতার সম্পর্ক।
বিপ্লবের অনন্য সাক্ষী মিষ্টির দোকান
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট, জালালাবাদ পাহাড়ে অবস্থান এবং ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণসহ নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনার মূল কেন্দ্র ছিল বোস ব্রাদার্স। সূর্য সেনের নেতৃতে বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তখন সেখানে শুধাংশুও ছিলেন। দুই ঘণ্টার তীব্র যুদ্ধে বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন শহীদ হন এবং প্রায় ১০০ ব্রিটিশ সৈন্য নিহত হয়। এমনকি এই আন্দোলনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে এবং মনোবল বাড়াতে শুধাংশু তার মিষ্টির দোকানে নিজেদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনার আয়োজন করতেন।
১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে যখন সূর্য সেনের নেতৃত্বে তীব্র আক্রমণ শুরু হয়, তখনও শুধাংশু তার সহযোদ্ধাদের সাথে সামিল হন। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিপ্লবীরা বোস ব্রাদার্সের মিষ্টির স্বাদ নিয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতেন। সাধারণ মিষ্টির দোকান থেকে এ দোকান রূপ নেয় এক বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গে।
বোস ব্রাদার্সের আজকের অবস্থা
আজ, বোস ব্রাদার্স একটি ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকান হিসেবে চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকার নন্দনকানন চৌরাস্তার মোড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশের দোকানপাটের ভিড়ে বোস ব্রাদার্স একটি স্বতন্ত্র জায়গা দখল করে রেখেছে। দোকানটি আট-দশটি সাধারণ মিষ্টির দোকানের মতো দেখতে হলেও এর ইতিহাস একে করেছে অতুলনীয়। রসগোল্লা, কালোজাম, বাদশাভোগসহ প্রায় ১৫ প্রকার মিষ্টি এখানে বিক্রি হয়, যা ক্রেতাদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয়। তবে ক্রেতাদের প্রথম পছন্দ থাকে রসমালাই, দধি এবং রসগোল্লার মতো আদি মিষ্টি।
দোকানের বর্তমান মালিক তরুণ কান্তি বোস। বাবার কাছ থেকে পাওয়া ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসার দায়িত্ব তিনি কাঁধে নিয়েছেন। তরুণ কান্তি বোস মিষ্টি বানানোর গুণেই কেবল নয়, বরং পরিবারের ঐতিহ্য রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থেকেছেন। ক্রেতাদের মুখে শতবর্ষ ধরে এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির দোকানের কথা শোনা যায়।
ঐতিহ্যের পথে বাধা: এক শঙ্কিত ভবিষ্যৎ
তবে এতসব সফলতার মাঝে বোস ব্রাদার্সের জন্য ভবিষ্যৎ যথেষ্ট উদ্বেগজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঐতিহাসিক এই দোকানটি নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অতিরিক্ত করের বোঝা এবং বিভিন্ন জরিমানার চাপের কারণে দোকানের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া তরুণ কান্তি বোসের জন্য ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রকম প্রশাসনিক চাপ এবং নিয়মিত জরিমানার কারণে মিষ্টির মান ধরে রাখা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র ঐতিহ্য রক্ষার্থেই এই পরিবারটি কঠিন সংগ্রামের পথে অটুট রয়েছে।
তরুণ কান্তি বোস বলেন, ‘এটি শুধুই মিষ্টির দোকান নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এখানে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বংশের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের গল্প। অনেকেই বুঝতে চায় না এই ঐতিহ্যের মূল্য। তবে আমরা আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী এর ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
মিষ্টি তৈরির গোপন রহস্য
বোস ব্রাদার্সের মিষ্টির বিশেষত্ব এর স্বাদে। প্রতিটি মিষ্টি নরম ও মোলায়েম, মুখে দিলেই যেন মিশে যায়। তাদের এই মিষ্টির বিশেষ স্বাদের পিছনে রয়েছে বিশেষ তরিকাও। মিষ্টি তৈরিতে খুব কম পরিমাণে আটা বা সুজি ব্যবহার করা হয়, মূল উপাদান থাকে দুধের
ছানা, যা মিষ্টিকে নরম ও মোলায়েম করে তোলে। প্রতিদিন প্রায় ১৩০–১৫০ লিটার দুধ দিয়ে মিষ্টি তৈরি করা হয়। দোকানে এসে মিষ্টি খাওয়ার পাশাপাশি অনেকেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যাকেট ভর্তি করে কিনে নিয়ে যান।
এই বিশেষ প্রস্তুত প্রণালীই বোস ব্রাদার্সের মিষ্টিকে করেছে অনন্য। তরুণ কান্তি বোস বলেন, ‘মিষ্টির মান বজায় রাখতে আমরা কোনো কিছুর সঙ্গে আপোস করি না। এখানকার মিষ্টি এখনো পূর্বপুরুষের সৎভাবে বানানোর নিয়মেই তৈরি হয়।’
তিন পুরুষের ঐতিহ্য ও সংগ্রাম
বোস ব্রাদার্সের যাত্রা শুরু হয়েছিল সারদা চরণ বোসের হাত ধরে। এরপর দায়িত্ব নেন তার ছেলে শুধাংশু বিমল বোস, যিনি সশস্ত্র বিপ্লবী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। শুধাংশু তার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই দোকানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার পরবর্তী প্রজন্ম, তরুণ কান্তি বোস, এখনও ঐতিহ্যবাহী এই ব্যবসাকে ধরে রেখেছেন। তরুণ কান্তি বোসের বয়স এখন ৬০ বছর, এবং তিনি বাবার কাছ থেকে মিষ্টি বানানোর প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন।
বস্তুত, বোস ব্রাদার্স এখনো শুধু একটি মিষ্টির দোকানই নয়, এটি বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসের একটি অংশ। তিন প্রজন্মের ঐতিহ্য, পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের ফলেই আজ এটি একটি অনন্য স্থানে পৌঁছেছে। শতবর্ষ ধরে এই দোকানটি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে, এবং এর ঐতিহ্য মিষ্টিপ্রেমীদের মন জয় করে আসছে।
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে বোস ব্রাদার্স
যদিও বোস ব্রাদার্স তার ঐতিহ্য আর গুণমান বজায় রেখে চলছে, তবে বর্তমান পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বিভিন্ন প্রশাসনিক চাপ এবং জরিমানার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী দোকানটি টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ছে। তরুণ কান্তি বোস জানান, ‘বাহ্যিক প্রভাব আর নানা চাপের কারণে এই ঐতিহ্যবাহী দোকানটি হয়তো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এটি শুধু একটি দোকান নয়, এটি আমাদের পরিবারের সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের এক জীবন্ত নিদর্শন।’
অসংখ্য মানুষের স্মৃতিতে গাঁথা এই দোকানটি একদিন হয়তো শুধু গল্পের মাধ্যমে জানা যাবে। আজকের ব্যস্ত শহরের মাঝে অবিরাম মিষ্টির স্বাদ নিয়ে চলা বোস ব্রাদার্স ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক অমলিন স্মৃতি।