চট্টগ্রাম নগরের ব্যস্ত জামাল খান সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ঐতিহ্যবাহী সাদা-ধূসর ভবন, যা দেখে অনায়াসে বলাই যায়, এটি কোনো সাধারণ স্কুল নয়। এটি হলো খাস্তগীর স্কুল (পুরো নাম ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়)।
১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটি শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়; এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের অংশ, নারী শিক্ষার বাতিঘর, সংগ্রামের এক জীবন্ত ইতিহাস। বাংলাদেশের নারী শিক্ষা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং বিভিন্ন গুণীজনের স্মৃতিবিজড়িত এই বিদ্যালয়টি এখনো শতবর্ষ পেরিয়েও নতুন প্রজন্মের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে রয়েছে।
ডা. খাস্তগীর স্কুলের ইতিহাস বলতে গেলে যে নামটি প্রথমেই মনে আসে, তিনি হলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। সাত বছর বয়সে যখন এই বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, তখন থেকেই তার মেধা ও মনোবল স্কুলের শিক্ষক ও সহপাঠীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
মালেকা বেগমের লেখা “প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার” বই থেকে জানা যায়, তিনি তৃতীয় শ্রেণি থেকেই শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিলেন এবং ম্যাট্রিক পরীক্ষায় চট্টগ্রাম বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এই সাফল্য তাকে চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও আলাদা পরিচিতি এনে দেয়। তার ইতিহাসের শিক্ষিকা ঊষা দি তাকে ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মীবাইয়ের সংগ্রামের গল্প শোনাতেন। এই গল্পগুলোই তার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল জাতীয়তাবোধের বীজ।
ঊষা দি’র দেয়া “ঝাঁসীর রানী” বইটি প্রীতিলতার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তিনি লক্ষ্মীবাইয়ের মতোই এক সংগ্রামী চরিত্রের অধিকারিণী হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য প্রীতিলতা তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, যা শুরু হয়েছিল এই বিদ্যালয়েরই প্রাঙ্গণে। সেইসব ক্লাসরুম, সেইসব করিডোরে প্রতিটি পদক্ষেপে বেজে উঠেছে তার সাহসিকতার গাথা। আজ এই প্রাচীন বিদ্যালয়টিকে দেখে তার শৈশব ও কৈশোরের সেই বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো মনে পড়ে।
এই বিদ্যালয়েরই আরেক ছাত্রী ছিলেন কল্পনা দত্ত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আরেক উজ্জ্বল নাম, যিনি প্রীতিলতার বন্ধু এবং সহযোদ্ধা ছিলেন। দুজনে একই মাঠে ব্যাডমিন্টন খেলতেন, গল্প করতেন, আর নিজেদের মধ্যে বিনিময় করতেন সাহসিকতার গল্প। কল্পনা দত্ত পরবর্তীতে তার স্মৃতিকথায় লিখেছিলেন, “ঝাঁসীর রানির গল্প শুনে আমরা নিজেদের বিপ্লবী ভাবতে শুরু করেছিলাম।”
এই দুই সংগ্রামী নারীর পদচারণায় খাস্তগীর বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ হয়ে উঠেছিল এক প্রতীকী মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চ। তাদের সেই সাহসিকতার গল্প এখনো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নতুন শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জোগায়।
খাস্তগীর স্কুলের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ও পরিবেশ
স্কুলটির স্থাপত্যশৈলীও প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এই সাদা-ধূসর ভবনটি কেবল বাইরে থেকেই দেখা যায়, যেন একটা প্রাচীন দুর্গ। প্রথমবার যখন সাদা-ধূসর ভবনটির দিকে তাকাই, তখন মনে হয়েছিল এটি ঠিক যেন স্কুল নয়; বরং কোনো পরিত্যক্ত প্রাসাদের মতো।
গেট পেরিয়ে যখন বিদ্যালয়ে প্রবেশ করি, তখন দেখতে পাই বিশাল এক প্রাঙ্গণ। মূল ভবনটি ছাড়াও এখানে আছে আরও কয়েকটি ভবন, যেগুলো স্বাধীনতার পরে এবং পাকিস্তান আমলে নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমলের ভবনটি সবচেয়ে উঁচু, যা দেখতে অনেকটাই রাজকীয়। এই প্রাচীন ভবনটি যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ভবনটির নিচে ছিল শ্রেণিকক্ষ, অফিস, এবং শিক্ষকদের কামরা। দোতালায় ছিল বোর্ডিং, যেখানে ৫০-৬০ জন মেয়ে থাকত। খাস্তগীর স্কুলের বোর্ডিংয়ের স্মৃতি অনেক ছাত্রীর মনেই আজও তাজা। এই বোর্ডিং ছিল শুধুমাত্র চট্টগ্রাম শহরের নয়, বরং বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ছাত্রীদের জন্যও এক নির্ভরযোগ্য আশ্রয়।
কুয়োর গল্প ও ভূতুরে পরিবেশ
ডা. খাস্তগীর স্কুলের একটি বিশেষত্ব হলো এর ভূতুরে কাহিনী। স্কুলের পিছনে ছিল একটি কুয়ো, যাকে ঘিরে নানা গল্প-কাহিনী প্রচলিত। কথিত আছে, এই কুয়োতে হাত উঠে আসত, আর সে হাত ছাত্রীদের টেনে নিয়ে যেত। এছাড়াও রয়েছে বিশাল শিরীষ গাছের পেছনে পেত্নীর কাহিনী, যা ছাত্রীরা একা একা টয়লেটে যেতে ভয় পেতো। এইসব গল্প-কাহিনী শুধু ছাত্রছাত্রীদের নয়, শিক্ষকদের মনেও এক ধরনের ভীতির সঞ্চার করেছিল।
স্কুলের কর্মচারী আরিফুর ইসলাম নয়ন জানান, একসময় এই ভবনটি হাসপাতাল ছিল এবং সেখানে অনেক রোগীর মরদেহ, হাড় এবং কংকাল পড়ে থাকত। যুদ্ধের সময়ও এই স্কুলটি মর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই গল্পগুলোই হয়তো ভবনটির সঙ্গে একটি ছমছমে ভাব যোগ করেছে, যা আজও সবার মনে রয়ে গেছে।
নারী শিক্ষা প্রসারের অগ্রদূত: ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর
ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর ছিলেন ভারতবর্ষের প্রথম প্রজন্মের গ্র্যাজুয়েট চিকিৎসক, সমাজ সংস্কারক ও প্রবন্ধলেখক। তিনি চট্টগ্রামের নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য বড় ভূমিকা পালন করেছেন। ১৮৭৮ সালে তিনি এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা তখন ভার্নাকুলার মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। পরবর্তীতে তার জামাতা যাত্রামোহন সেন বিদ্যালয়টি উন্নীত করে তার নামেই নামকরণ করেন। এই বিদ্যালয়টি তখন থেকেই চট্টগ্রামের নারী শিক্ষার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে শুরু হয়েছিল এই বিদ্যালয়ের যাত্রা। তাদের মধ্যে ছিলেন আন্না সেন, প্রেম কুসুম এবং জুনি। প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষিকা সুশীলা সেনগুপ্তার তত্ত্বাবধানে এই বিদ্যালয়টি এগিয়ে যেতে থাকে।
পরিত্যক্ত ভবনের গর্বিত গৌরব
খাস্তগীর বিদ্যালয়ের পুরানো ভবনটি বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হলেও তা ভাঙার অনুমতি মেলেনি। প্রশাসনিক কাজে এখনো ব্যবহার করা হয় ভবনটির নিচতলাটি, যদিও দোতলাটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত। ফাটল ধরা ছাদ আর জং ধরা লোহার সিঁড়ি এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই সিঁড়িটি ছিল একসময় দোতলায় ওঠার একমাত্র উপায়, যা এখন প্রায় ভগ্নপ্রায়। কিন্তু এই পুরানো ভবনটি যেন আজও যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
নিয়মানুবর্তিতার আদর্শ
খাস্তগীর বিদ্যালয়ের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এর নিয়মানুবর্তিতা। এক সময় এই বিদ্যালয়টির বোর্ডিং হোস্টেলে সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘন্টা বাজিয়ে ছাত্রীরা উঠত। সাতটায় নাস্তা সেরে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ক্লাসের পড়া তৈরি করতে হতো। তারপর গোসল করে তৈরি হয়ে যেতে হতো ক্লাসে। প্রতিটি কাজের জন্য সময় বরাদ্দ থাকত এবং তা অমান্য করার সুযোগ ছিল না। বৃহস্পতিবারে মিলাদ ও খাসির মাংস, পরোটার আয়োজন, শুক্রবারে সাজগোজ ও শাড়ি পরার দিন, এসব নিয়মের মধ্যে দিয়ে ছাত্রীরা বড় হয়ে উঠত।
একটি আদর্শের ধারক
ডা. খাস্তগীর বিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি আদর্শের নাম। একসময় ঢাকার কামরুন্নেসা স্কুলকে সেরা বলা হলেও চট্টগ্রামে খাস্তগীর স্কুলই ছিল মা-বাবাদের প্রথম পছন্দ। বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা শিক্ষার পাশাপাশি বিতর্ক, গার্লস গাইড, রেড ক্রিসেন্টসহ নানা সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজও খাস্তগীরকে চট্টগ্রামের সেরা মেয়েদের স্কুল হিসেবেই ধরা হয়।
২০২৪ সালের জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে খাস্তগীর বিদ্যালয় দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তের মতো সংগ্রামী নারী, ভাস্কর্য শিল্পী নভেরা আহমেদ, নারীনেত্রী আইভী রহমান, মেরি কুরী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাকেবা আলী, সাহিত্যিক নীলুফার জহুর, বিখ্যাত কার্ডিওলোজিস্ট ড. সুফিয়া রহমানসহ আরও অনেকে। তাদের অবদান এবং কৃতিত্ব এই বিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
খাস্তগীর বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসন প্রায়ই নিজেদের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। নতুন শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের জন্য প্রতিবছর ভর্তিপরীক্ষা নেয়া হতো, যা করোনা মহামারির পর থেকে লটারি পদ্ধতিতে চলছে। তবে তাতে শিক্ষার মান যেন না কমে, সেদিকে কড়া নজর রাখছেন প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা।
এক ঐতিহ্য, এক স্বপ্ন
খাস্তগীর স্কুল এখনো তার ঐতিহ্যের স্মৃতিবিজড়িত হয়ে গর্বিতভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এ বিদ্যালয় শুধু প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত কিংবা অন্যান্য গুণী ব্যক্তিত্বদের শিক্ষাজীবনের স্মৃতিবিজড়িত একটি প্রাঙ্গণ নয়; এটি দেশের নারী শিক্ষার সংগ্রামের ধারক ও বাহক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বিদ্যালয় চট্টগ্রামের নারী শিক্ষার প্রসারে অবদান রেখেছে। আজকের দিনেও এই বিদ্যালয়টি চট্টগ্রামের মেয়েদের শিক্ষার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়।
ডা. খাস্তগীর বিদ্যালয় তাই কেবল একটি স্থাপনা নয়, এটি একটি আদর্শ, একটি গৌরবের অংশ। এই স্কুলের দেয়ালগুলো যেন মিশে রয়েছে এক একটি বীরত্বগাঁথার সঙ্গে, যারা প্রেরণার আলোকবর্তিকা হয়ে আজও পথ দেখাচ্ছে।