বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে করা দুটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি এবং সংশ্লিষ্ট স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) পুনরায় পর্যালোচনা করছে। চুক্তিগুলোর দুর্বল দিকগুলো চিহ্নিত করে এগুলো বাংলাদেশের স্বার্থের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত কাজের নেতৃত্ব দিচ্ছে এবং ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মতামত চেয়েছে।
ভারতের সঙ্গে করা দুটি প্রধান চুক্তি হলো- উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি ও চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার চুক্তি।
এই চুক্তিগুলো ২০১৫ এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিগুলোর আওতায় ভারতীয় পণ্য সমুদ্র ও নদীপথ ব্যবহার করে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে পৌঁছায়। এরপর সড়কপথে তা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পাঠানো হয়। এতে ভারতের পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ কমলেও বাংলাদেশ তেমন লাভবান হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন, চুক্তির মাধ্যমে ভারত নামমাত্র ফি ও চার্জের বিনিময়ে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাচ্ছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে ভারতীয় জাহাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টিও সমালোচিত হয়েছে।
চুক্তিগুলোর দুর্বলতা মূল্যায়ন করতে সম্প্রতি নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ, পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়ন পাওয়ার পর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক আয়োজন করা হবে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেছেন, “আমরা চুক্তিগুলো পর্যালোচনা করছি। ইতোমধ্যে সেখানে বেশ কিছু স্বার্থবিরোধী শর্ত চিহ্নিত করেছি। বিভিন্ন সংস্থার মতামত নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।”
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে চুক্তিগুলোর কয়েকটি দুর্বল দিক চিহ্নিত করে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তি’র আওতায় বড় আকৃতির জাহাজ বাংলাদেশের নদীপথ ব্যবহার করছে, যা নদীর স্বাভাবিক পরিবেশ এবং বন্দর ব্যবস্থাপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
উল্লেখ্য, চুক্তির আওতায় ভারতের সাতটি সমুদ্রবন্দর এবং বাংলাদেশের তিনটি সমুদ্রবন্দর ও চারটি নদীবন্দরের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশি নদীবন্দরের গভীরতা মাত্র ৪ মিটার হওয়ায় সেখানে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার গ্রসটনের জাহাজ চলাচল করতে পারে। কিন্তু চুক্তির আওতায় ছয় হাজার গ্রসটনের বড় জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া, আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশনের নিয়ম এবং বাংলাদেশ শিপিং অর্ডিন্যান্সের শর্ত চুক্তিতে মানা হয়নি। ফলে এটি দেশের বন্দর ও নৌপথের জন্য ক্ষতিকর বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
সম্প্রতি ভারতের পক্ষ থেকে চুক্তির আওতায় তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের সুযোগ চাওয়া হয়েছে। তারা প্রস্তাব দিয়েছে, বাংলাদেশের পণ্য ভারতের সমুদ্রবন্দর হয়ে অন্যান্য দেশে পাঠানো হবে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জে সামিট পোর্ট এবং কক্সবাজারকে ‘পোর্ট অব কল’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, কক্সবাজারের নৌচ্যানেল পলিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এটি বাণিজ্যিক নৌচলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। অন্যদিকে সামিট পোর্ট অ্যালায়েন্সকে পোর্ট অব কল হিসেবে যুক্ত করার বিষয়ে সরকার নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছে।
বাংলাদেশের সামুদ্রিক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত খুলতে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর একটি বড় ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। এই বন্দর আন্তর্জাতিক প্রধান নৌপথের সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে ভারত হয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য পরিবহন করার প্রস্তাব সাপ্লাই চেইনের জন্য হুমকি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সব পক্ষের মতামত নিয়ে প্রয়োজন হলে চুক্তিগুলো সংশোধন বা নতুন আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে এখনো চুক্তি বাতিল বা সংশোধনের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
বাংলাদেশ সরকার চুক্তিগুলোর কার্যকারিতা ও স্বার্থ সংরক্ষণে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে বলে আশা করা হচ্ছে।