প্রচ্ছদঅর্থ-বাণিজ্যটাকা ছাপাতে খরচ বেড়েছে, কমেছে মান

টাকা ছাপাতে খরচ বেড়েছে, কমেছে মান

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল ভিত্তি মুদ্রার ওপর নির্ভরশীল। সেই মুদ্রা বা টাকা ছাপাতে খরচ বেড়েছে। দেশের টাঁকশালে মুদ্রা ছাপার যন্ত্রের বয়স ৪০ বছরেরও বেশি, যা মুদ্রার মান ও স্থায়িত্বে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পুরনো যন্ত্র ব্যবহারের ফলে মুদ্রার মান কমছে এবং স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে, ফলে বারবার মুদ্রা ছাপাতে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে।

টাঁকশালের মুদ্রা ছাপার যন্ত্রগুলোর আয়ুষ্কাল সাধারণত ১৫ বছর। অথচ বাংলাদেশে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো প্রায় ৪০ বছরেরও বেশি পুরনো। এই পুরনো যন্ত্রগুলির কারণে মুদ্রার মান নষ্ট হচ্ছে এবং স্থায়িত্ব কমে যাচ্ছে। বারবার মেরামতের প্রয়োজনীয়তার কারণে মোটা অঙ্কের অর্থ নষ্ট হচ্ছে এবং মুদ্রা ছাপার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়াও, পুরনো যন্ত্রের যন্ত্রাংশ পাওয়া কঠিন, যা মেরামত প্রক্রিয়াকে জটিল ও ব্যয়বহুল করে তুলছে।

অধিকাংশ দেশ বর্তমানে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়তে এগিয়ে চলেছে, যেখানে ডিজিটাল লেনদেনের গুরুত্ব বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও ক্যাশলেস লেনদেনকে উৎসাহিত করছে এবং গত বছর থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনের প্রচলন বাড়িয়েছে।

সরকার ‘বিনিময়’ অ্যাপ চালু করেছে, যা আন্তঃব্যাংকিং লেনদেন সহজ করে তুলছে। এছাড়াও, ‘বাংলা কিউআর’ অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহক ও দোকানিদের মধ্যে সহজ লেনদেন সম্ভব হচ্ছে।

টাঁকশালের মেশিন: মেরামত না নতুন, কোনটি লাভজনক?

টাঁকশালের মেশিনগুলো সুইজারল্যান্ড ও জার্মানির তৈরি, যা ১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে স্থাপন করা হয়েছিল। এখন এসব মেশিন তৈরি করা হয় না, ফলে যন্ত্রাংশ পাওয়া কঠিন।

মেশিনের যন্ত্রাংশ সংযোজনের জন্য বিশেষভাবে অর্ডার দিতে হয়, যা অত্যধিক খরচের কারণ। একটি নাট বানাতে হাজার টাকা খরচ হতে পারে। এছাড়াও, যন্ত্রাংশের মূল্য অনেক বেশি হওয়ায় ব্যয় বাড়ছে।

অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন যুক্ত করেছেন, “টাঁকশালের মেশিনগুলো ৪০ বছরের পুরনো, যা মুদ্রার মান ঠিক রাখতে অক্ষম। নতুন মেশিন স্থাপন করা অত্যাবশ্যক, নতুবা মুদ্রার গুণগত মান ও স্থায়িত্ব কমে যাবে।”

টাঁকশালের মেশিন ওভারহোলিং করতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে, যা সরকারের জন্য অতিরিক্ত বোঝা। নতুন মেশিন স্থাপনে আড়াইশ কোটি টাকা খরচ হতে পারে, যা বর্তমানে মুদ্রা ছাপার জন্য ওভারহোলিংয়ের পরিকল্পনা নিয়ে অভিযোগ উঠেছে।

টাঁকশালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আশরাফুল আলম বলছেন, “টাঁকশাল বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা হয়। পুরনো মেশিন ওভারহোলিংয়ের আগে কিছু কাজ করা হয়েছিল, তবে নতুন সরকার পরিবর্তনের পর নতুন কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।”

অর্থনীতিবিদ ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন যুক্ত করেছেন, টাঁকশালের মেশিনগুলো ৪০ বছরের পুরনো, যা মুদ্রার মান ঠিক রাখতে অক্ষম। নতুন মেশিন স্থাপন করা অত্যাবশ্যক, নতুবা মুদ্রার গুণগত মান ও স্থায়িত্ব কমে যাবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা, ৫০০ টাকার নোটে ৪ টাকা ৭০ পয়সা খরচ পড়ে। অন্যান্য নোটের খরচও উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে বেশি খরচ হয় কয়েন তৈরিতে, যেখানে প্রতিটি কয়েনে প্রায় সমপরিমাণ টাকা খরচ হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা তথা ক্যাশলেস ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে, যাতে মুদ্রা ছাপার খরচ কমানো যায়।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে মুদ্রা ছাপা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালে টাঁকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ১৯৮৯ সালে গাজীপুরে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। টাঁকশাল শুধুমাত্র মুদ্রা ছাপায় না, বিভিন্ন নিরাপত্তাসামগ্রীও মুদ্রণ করে, যেমন সঞ্চয়পত্র, স্ট্যাম্প, চেক বই, প্রাইজবন্ড ইত্যাদি।

টাঁকশালের মেশিনগুলো আধুনিক প্রযুক্তির না হলে মুদ্রা জাল করা হবে, ছাপার খরচ বেশি হবে, এবং কাঁচামাল বেশি লাগবে। ওভারহোলিংয়ের ফলে মেশিনের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায় এবং মুদ্রার গুণগত মান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মুদ্রার নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য ঘাটতি থাকায় নকল মুদ্রার সমস্যা বাড়তে পারে, যা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তোলে।

টাঁকশালের পুরনো মেশিনের পরিবর্তে নতুন মেশিন স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডিজিটাল মুদ্রা ও ক্যাশলেস সোসাইটির উন্নয়নে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা মুদ্রা ছাপার খরচ কমাবে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে। এছাড়াও, মুদ্রা ছাপার যন্ত্রের আধুনিকীকরণ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপার ব্যবস্থায় পুরনো যন্ত্রের ব্যবহার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় হুমকি সৃষ্টি করছে। মুদ্রার মান ও স্থায়িত্ব বজায় রাখতে নতুন মেশিন স্থাপন অপরিহার্য।

পাশাপাশি, ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে অগ্রগতি চালিয়ে মুদ্রা ছাপার খরচ কমানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ এবং টাঁকশালের আধুনিকীকরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও পড়ুন

googlee2fa12e91d785426%20(1).html