রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদফিচারচট্টগ্রামের ডিসি হিল পার্ক: কম খরচে পাত্রী দেখার সাশ্রয়ী...

চট্টগ্রামের ডিসি হিল পার্ক: কম খরচে পাত্রী দেখার সাশ্রয়ী পন্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক

সূর্য তখন পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে, বিকেলের রোদে ঝলমলে চট্টগ্রামের ডিসি হিল। শহরের নন্দনকানন এলাকার এই পার্ক একসময় কেবলমাত্র বিনোদনের জায়গা ছিল। কিন্তু এই পার্ক এখন নতুন ধরণের সামাজিক মেলবন্ধনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। খরচ কমানোর ভাবনায় অনেকেই এখন পাত্রী দেখার জন্য ডিসি হিল পার্কে আসছেন, ঠিক যেমনটা আমি দেখলাম।

সেদিন বিকেলে একে একে এসে হাজির হলেন দুই পরিবারের মানুষ। পাত্রপক্ষ ও পাত্রীপক্ষ। চায়ের কাপ, ফুসকা-চটপটির ছোট আয়োজন আর স্বাভাবিক হাসি-আলাপে জমজমাট হয়ে উঠল তাদের মিটিং। পাত্র-পাত্রী উভয়েই নিজেদের পরিবারের মুরুব্বিদের সালাম করে, এক কোণে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ আলাপ করলেন। বড়রাও বসে গেলেন পরস্পরকে বুঝে নিতে, সম্পর্কটিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবার আলোচনা করতে।

তবে এটুকুই নয়, এই পুরো ঘটনার পেছনে লুকিয়ে রয়েছে কিছু আকর্ষণীয় এবং সমাজে নতুন ধরণের দৃষ্টান্তের কথা। এই নতুন ধরণের ‘পাত্রী দেখা’র ধারা ক্রমেই জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, বিশেষ করে ব্যয়ের দিক থেকে বাঁচার একটি সহজ উপায় হিসেবে।

কম খরচে পাত্রী দেখা, রেস্টুরেন্ট ছাড়াই!

খরচ কমানো এবং সহজভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই এই নতুন উদ্যোগ। কথোপকথনে জানা গেল, পাত্রের মামা তুহিন আসলে পুরো ব্যাপারটিকে সরল আর সাশ্রয়ী রাখতে চেয়েছেন। জানালেন, তিনি আগে কয়েকবার পাত্রী দেখতে গিয়েছেন, কিন্তু প্রতিবারই খরচের পরিমাণ দেখলে মনটা খারাপ হয়ে যেত। পাত্রী দেখা মানে রেস্টুরেন্টে যান, খাবার অর্ডার করেন, সেই সঙ্গে প্রায় এক ডজন মানুষ যোগ হয়েই যায়।

তুহিনের মতে, “বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা বা পরিবারকে একত্রে বসানোর জন্য এত খরচের দরকার নেই। চট্টগ্রামের ডিসি হিলের মতো জায়গায় এসে খরচও কমে আর মিটিংও ঠিকভাবে হয়।” প্রবাসী ভাগ্নের জন্য পাত্রী দেখতে আসার এই অভিজ্ঞতা সত্যিই আলাদা। পার্কে এসে সবাই একসঙ্গে দেখা করে সহজেই নিজেদের মধ্যে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। আরেক দিক থেকে খরচও অনেক কমেছে।

সমাজের চাপ, রেস্টুরেন্টের ভিড় আর অযথা খরচ

খরচের বিষয়টি নিয়ে পাত্রীপক্ষের মা হামিদা আক্তারের সাথেও কথা হলো। রান্নাবান্না ছাড়াই বাইরে দেখা করার এই ব্যবস্থা তার কাছে সুবিধাজনক। বলছিলেন, “আগে পাত্রী দেখাতে গেলে কতো কিছু চিন্তা করতে হতো! এখন বাইরে গিয়ে দেখা হলে ঘরের মেয়েদের কোনো বাড়তি কাজ করতে হয় না, রান্নার চিন্তা নেই, সাজানো-গোছানোর ঝামেলাও নেই।”

যে সমাজে বিয়ে মানেই রাজকীয় আয়োজন আর বিশাল খরচের প্রতিযোগিতা, সেখানে এভাবে সহজে পাত্রী দেখা একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। মুরুব্বিরা মনে করেন, বিয়ের খরচের চাপ থেকে কিছুটা মুক্তি পাওয়া উচিত। পরিবারগুলোর কথোপকথন আর তাদের চোখে-মুখে প্রশান্তি দেখেই বোঝা যায়, কম খরচে বিয়ের এই নতুন পদ্ধতি তাদের কতটা স্বস্তি দিয়েছে।

পার্কের আড্ডায় পাত্রী দেখা এখন নতুন নিয়ম

অলস বিকেলে চট্টগ্রামের ডিসি হিল, সিআরবি কিংবা চট্টগ্রামের আরও অনেক পার্কে এখন নিয়মিত এধরণের মিটিং দেখা যায়। বিশেষ করে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এমন অনেক পরিবার পাত্রী দেখার জন্য পার্কে আসেন। পার্কে দাঁড়িয়ে চটপটি বিক্রি করছেন সুমন। বলছিলেন, “প্রতিদিনই এখানে কাউকে না কাউকে দেখবেন। সপ্তাহে ৪-৫ দিন তো এমন দেখি। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করে।”

সুমনের মতো পার্কের অনেক ছোট ব্যবসায়ীই জানান, পাত্রী দেখা আর চটপটি-ফুসকা খাওয়ার এই নতুন ধারা তাদের ব্যবসাকেও খানিকটা চাঙ্গা করেছে। চট্টগ্রাম শহরের এসব জায়গা তাই এখন অলস বিকেলের বিনোদনের জায়গা নয় কেবল, বরং বিয়ের জন্য সম্পর্কের সম্ভাবনা তৈরি করতেও ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিয়ের খরচের বোঝা কমানো প্রয়োজন

একসময় পাত্রী দেখা মানে ছিল বিপুল আয়োজন, বড় ধরনের খরচের ব্যাপার। ধনী থেকে গরিব, সবার কাছেই বিয়েতে খরচ করা একটি সম্মানের বিষয়। সমাজের মান ধরে রাখতে গিয়ে অনেকেই তাদের সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করে থাকেন। কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকেই আজ পরিবর্তনের দিকে যাচ্ছেন।

পাত্রী দেখার জন্য খরচ বাঁচাতে এই পদ্ধতি চট্টগ্রামে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। চট্টগ্রামের ডিসি হিল কিংবা পার্কের মতো জায়গায় আসা অনেকেই খুশি এই সাশ্রয়ী ব্যবস্থায়। সাধারণ মানুষও এখন সাশ্রয়ী এবং সহজ উপায়ে পাত্রী দেখা বা পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথা বলাকে পছন্দ করছেন।

বদলেছে চিন্তা-ভাবনা

এতদিন চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জেলাতে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা মানে ছিল এক বড় আয়োজন, বিশাল খরচ। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বড় আড্ডা, খাবার ব্যবস্থা আর মান রাখার চিন্তা থেকে বের হয়ে এসে এখন অনেকেই খরচ কমানোর নতুন নতুন উপায় খুঁজছেন। এভাবেই আধুনিক যুগে নতুন একটি সামাজিক প্রবণতা জন্ম নিচ্ছে।

তুহিনের মতে, “আমরা নিজেরাই অযথা এতসব প্রথা বাড়িয়ে ফেলেছি। বিয়েতে অনেক টাকা খরচ করার চেয়ে সম্পর্কটাকে গুরুত্ব দেয়া দরকার।” একই কথা বলছিলেন পাত্রীর মা হামিদা আক্তারও। বলছিলেন, “আজকাল সবাই ব্যস্ত। একদম কম খরচে চট্টগ্রাম ডিসি হিল পার্কে গিয়ে আলোচনা করার মতো ব্যবস্থা আসলে অনেক স্বস্তির।”

সামগ্রিক পরিসরে বিয়ের খরচ

বিয়ে মানেই বিশাল আয়োজন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মানুষদের কাছে বিয়ের আয়োজনে খরচ করা গর্বের বিষয়। যত বেশি খরচ, সমাজের মধ্যে তত বেশি গর্বের বিষয় হয়ে ওঠে। এই প্রতিযোগিতার মাঝে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে যান। সচ্ছল জীবনযাপনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এই বাড়তি খরচ।

মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি ভুগে। ছোট চাকরি, ছোট সংসার, তবুও লোকলজ্জার ভয়ে সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে খরচ করেন। পাত্রী দেখতে গেলেও পকেটে হাত দিয়ে হিসাব করতে হয়। তাই কম খরচে পাত্রী দেখা এখন অনেকের কাছে সহজ সমাধান।

সহজে, সাশ্রয়ীভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার নতুন পন্থা

খরচ কমানো এই পাত্রী দেখা পদ্ধতি এখন অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য। এভাবে দেখা-সাক্ষাৎ করে বিয়ে সম্পর্কে আলোচনা ও মনস্থির করার প্রক্রিয়া যেন নতুন করে ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। চট্টগ্রামের ডিসি হিল, সিআরবি কিংবা অন্যান্য পার্কের মতো জায়গাগুলো এখন ব্যয়ের দিক থেকে সাশ্রয়ী হওয়ায় বিয়ে-আলোচনার জন্য আদর্শ জায়গা হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

কিন্তু এই উদ্যোগ শুধু মাত্র চট্টগ্রাম নয়, ধীরে ধীরে দেশের অন্যান্য জায়গাতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে পারিবারিক বন্ধনের মানসিক চাপও কমিয়ে দিয়েছে। সমাজের অনেকেই এখন একে ইতিবাচক চোখে দেখছেন।

স্বচক্ষে পাত্রী দেখা এখন বুদ্ধিমানের কাজ

আসলে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা বা পাত্র দেখা, সেটা যে ধারাতেই হোক, স্বচক্ষে একবার দেখে নেয়া ভালো। তাই চট্টগ্রামের ডিসি হিল পার্কে গিয়ে কম খরচে এই মিটিংয়ের ব্যবস্থা দেখে একদিকে খুশি হচ্ছেন অভিভাবকরা। এধরণের উদ্যোগ শুধু সাশ্রয়ী নয় বরং সম্পর্কে বাস্তবতার ছোঁয়াও এনে দিচ্ছে।

চট্টগ্রামে যেমন বিয়েতে খরচের পরিমাণ একসময় অনেক বেশি ছিল, এখন সেই ধারায় পরিবর্তন আসছে। অনেকেই মনে করেন, বিয়ের প্রাথমিক আনুষ্ঠানিকতা যত সহজে ও সাশ্রয়ীভাবে করা যায়, ততই ভালো।

এমনভাবে বাইরে পাত্রী দেখা বা পার্কে দেখা-সাক্ষাৎ করা এক ধরণের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে দুই পরিবারকেই। সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানসিক চাপ কমে গেলে সম্পর্কটিও সুন্দর ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে মানুষের এই নতুন ধারা তাই এখন বিয়ের ক্ষেত্রে একটি সামাজিক আন্দোলনের মতোই বলে মনে হয়।

নতুন ধারা, সাশ্রয়ী আর আনন্দময় বিয়ে আয়োজন

চট্টগ্রামের ডিসি হিলের পার্কে গিয়ে বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা, এতে যেন শহরের লোকজন নতুন ধারা তৈরি করেছেন। সমাজের সামাজিক চাপ থেকে বেরিয়ে এসে এখন অনেকেই খরচ কমাতে পারছেন। নিজেদের সাধ্যের বাইরে গিয়ে খরচ না করে সাশ্রয়ীভাবে বিয়ের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার নতুন এই পদ্ধতি আরও বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে।

বিয়ে নিয়ে মানুষের চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন আসছে। সামাজিক বন্ধনে আটকে থাকা মানুষরা এই নতুন ধারা বেছে নিচ্ছেন নিজেদের এবং সমাজের সকলের স্বার্থে। এমনটি হলে কম খরচে, আনন্দময় একটি সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করা যাবে, যা বিয়ে সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে।

চট্টগ্রামের ডিসি হিলের বিকেলের এই দেখা সাক্ষাৎ শুধু পাত্রী দেখার জন্য নয়, বরং একটি সুন্দর সামাজিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পথ দেখাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও পড়ুন