রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদঅর্থ-বাণিজ্যআদানির বিরুদ্ধে ঘুষ-প্রতারণার অভিযোগ মার্কিন আদালতে: বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তির...

আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ-প্রতারণার অভিযোগ মার্কিন আদালতে: বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চুক্তির ভবিষ্যৎ কী?

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভারতের অন্যতম ধনী ব্যক্তি এবং আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি ও তার কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ফেডারেল আদালতে ঘুষ ও প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ পেতে ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ভারতের সরকারি কর্মকর্তাদের ২৫ কোটি ডলার ঘুষ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপ মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার সংগ্রহ করেছে।

মার্কিন আদালতের কৌঁসুলিরা দাবি করেছেন, বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ২০ বছরে প্রায় ২০০ কোটি ডলার মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে আদানি গ্রুপ একটি পরিকল্পিত প্রতারণা চালিয়েছে। গ্রুপের ভ্রাতুষ্পুত্র সাগর আদানি এবং তাদের সাবেক প্রধান নির্বাহী বিনীত জৈনসহ আরও আটজন এই অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন।

এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন আদালত গৌতম আদানি ও সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। আদালতের পক্ষ থেকে বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে এই পরোয়ানা হস্তান্তরের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে। এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগ দায়ের করেছে।

আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় সাড়া ফেলেছে। ভারতের রাজনীতিতে এই ইস্যুতে উত্তেজনা বাড়ছে। ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেস এ ঘটনায় সংসদীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে আদানিকে সুরক্ষা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে।

বাংলাদেশে আদানি চুক্তি: শুরু থেকেই বিতর্কিত

বাংলাদেশে গৌতম আদানি এবং তার কোম্পানি আদানি পাওয়ারের সঙ্গে বিদ্যুৎ চুক্তি নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ভারতের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের গড্ডায় ১৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য আদানি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তির শর্ত নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই সমালোচনা করে আসছেন।

চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আদানি পাওয়ারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ ক্রয় করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, এমনকি বিদ্যুৎ নেওয়া না হলেও বিপিডিবিকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রদান করতে হবে। এই শর্তকে দেশের স্বার্থবিরোধী এবং অসম বলে দাবি করেছেন জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা।

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে জটিলতা

চুক্তির শর্ত পূরণে সমস্যা দেখা দেওয়ায় আদানি গ্রুপ বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। বিদ্যুৎ বিল বাবদ আদানি পাওয়ারের বিপিডিবির কাছে পাওনা বর্তমানে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার ছাড়িয়েছে। এই বকেয়া বিল পরিশোধে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। এ অবস্থায় সরকার প্রতি মাসে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি করে পরিশোধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

বিদ্যুৎ চুক্তির এমন শর্ত এবং বিল পরিশোধের জটিলতা নিয়ে সম্প্রতি উচ্চ আদালত থেকে চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ এসেছে। তবে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে মার্কিন আদালতের এই অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক দিক হতে পারে। এই মামলার তথ্য ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিদ্যুৎ চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন এবং প্রয়োজনে বাতিল করা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, “আদানির বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগ নতুন নয়। দ্রুত সময়ে বিপুল সম্পদ অর্জনে এসব কার্যক্রম বড় ভূমিকা রেখেছে। মার্কিন আদালতের অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ হতে পারে। বিদ্যুৎ চুক্তি পুনর্মূল্যায়ন বা বাতিলের প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ রেফারেন্স হতে পারে।”

সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন চুক্তি পর্যালোচনায় বাংলাদেশ সরকার একটি কমিটি গঠন করেছে। কমিটিকে চুক্তির জাতীয় স্বার্থবিরোধী দিকগুলো চিহ্নিত করতে বলা হয়েছে। এই কমিটির অন্তর্ভুক্ত বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে যেসব তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে, সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই তথ্য বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, “আমরা চুক্তিগুলো পর্যালোচনা শুরু করেছি। বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে চুক্তির শর্তগুলো যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

আদানির প্রতিক্রিয়া

মার্কিন আদালতে অভিযোগ দায়েরের পর আদানি গ্রুপ একটি বিবৃতি দিয়ে এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে। তারা বলেছে, “আমাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সব ধরনের আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”

বিদ্যুৎ খাতে কর ফাঁকি ও শুল্ক অব্যাহতির অভিযোগ

বাংলাদেশে আদানি পাওয়ারের বিদ্যুৎ আমদানিতে প্রায় ৪০ কোটি ডলারের শুল্ক ফাঁকির প্রমাণও পাওয়া গেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তদন্তে দেখা গেছে, আদানি গ্রুপ শুল্ক ও কর অব্যাহতি নিয়ে সরকারি বিধি উপেক্ষা করেছে। এনবিআর এ অর্থ আদায়ের সুপারিশ করেছে।

বাংলাদেশের করণীয় কী?

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিদ্যুৎ চুক্তি বাতিল বা পুনর্মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মার্কিন আদালতের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হতে পারে। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে এই চুক্তি যাচাই করা এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে বিষয়টি তুলে ধরা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বড় একটি অংশ আদানি পাওয়ারের ওপর নির্ভরশীল। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদানি গ্রুপের বিদ্যুৎ কেনা বন্ধ করে দেশীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে।

আদানির ঘটনা বাংলাদেশের জন্য একমাত্র উদাহরণ নয়। এর আগেও সিমেন্স বাংলাদেশ লিমিটেড ঘুষ দিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল কোম্পানি টেলিটকের কাজ পেয়েছিল। পরে মার্কিন আদালতের মামলার মুখোমুখি হয়ে প্রতিষ্ঠানটি ১.৪ বিলিয়ন ডলার জরিমানা দেয়। এর পর সিমেন্স দীর্ঘদিন বাংলাদেশে কোনো কাজ পায়নি।

আদানির বিদ্যুৎ চুক্তির পুনর্মূল্যায়ন ও অনিয়ম প্রমাণিত হলে সিমেন্সের মতো পরিণতি হতে পারে।

মার্কিন আদালতে গৌতম আদানি ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বাংলাদেশের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশের স্বার্থ রক্ষা করা। পাশাপাশি, বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করা প্রয়োজন।

আদানির বিরুদ্ধে ওঠা আন্তর্জাতিক অভিযোগ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতকে নতুন করে সাজানোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

এই বিভাগের আরও পড়ুন