শনিবার, ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদচট্টগ্রাম১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়, কমল না চট্টগ্রামের যানজট

১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়, কমল না চট্টগ্রামের যানজট

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম নগরের সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে গত দেড় দশকে প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও যানজট নিরসনে তা কোনো কাজে আসেনি বলে এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। উল্টো যানজট বেড়েছে, কমেছে গাড়ির গতি। সড়ক দুর্ঘটনাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির ২০টি শহরের মধ্যে চট্টগ্রামের অবস্থান ১২তম। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক অবকাঠামো খাতে খেয়ালখুশিমতো উন্নয়ন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ উপেক্ষা করা হয়েছে। গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন, ট্রাফিক ও জংশন ব্যবস্থাপনায় কোনো ব্যয় করা হয়নি। অপরিকল্পিত উন্নয়নে পুরো টাকারই অপচয় হয়েছে।

চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দুটি সংস্থা সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ৩৮টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় ১৮ হাজার ৭২৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। সিডিএ ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, যার ব্যয় ১২ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রয়েছে তিনটি ফ্লাইওভার, একটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, একটি ওভারপাস এবং সড়ক নির্মাণ, সংস্কার ও সম্প্রসারণ প্রকল্প। চসিক ১৩টি প্রকল্পে ৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা শুরু থেকেই ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিরোধিতা করে আসছেন। তাদের আপত্তি সিডিএ আমলে নেয়নি। এত ব্যয়ের পরও সড়কে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। ২০১৮ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, নগরে চলাচলকারী যানবাহনের মধ্যে সবচেয়ে কম গতি বাসের। নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই গতি আরও কমে এসেছে। বর্তমানে গণপরিবহনের গতি ৫ থেকে ৭ কিলোমিটারের মধ্যে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার জয়নুল আবেদীন জানান, সড়কে নানা বিশৃঙ্খলা ও অযান্ত্রিক গাড়ি বাড়ার কারণে দিন দিন গাড়ির গতি কমছে।

বহদ্দারহাট থেকে নিয়মিত আগ্রাবাদে যাতায়াত করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মিনহাজ উদ্দিন। তিনি বলেন, বহদ্দারহাট থেকে আগ্রাবাদের দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। এই পথ পাড়ি দিতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ এই পথে দুটি ফ্লাইওভার ও একটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ২ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ৯০ হাজারেরও বেশি। নগরে চলাচলরত বাসের সংখ্যা মাত্র ২ হাজার ৭৫৬টি। একটি জরিপে দেখা গেছে, নগরের সড়কের ৭০ শতাংশ জায়গা ছোট গাড়ির দখলে থাকে। এসব গাড়িতে যাতায়াত করে মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে, সড়কের মাত্র ৩০ শতাংশ জায়গায় চলাচল করে ৭০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন।

২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের সড়কে ৬৮৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিহত হয়েছেন ৫৬৯ জন, আহত হয়েছে ৪৫৯ জন। ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে ৬১ শতাংশ।

পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া উন্নয়ন করলে তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাজে আসে না। শুধু টাকার অপচয় হয়। চট্টগ্রামের যানজট নিরসনে বাসকে অগ্রাধিকার, ট্রাফিক, জাংশন, রোড ও রিকশা ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু করলেই ৭০ শতাংশ সমাধান হয়ে যাবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবুল কাশেম স্বীকার করেছেন, সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা খাতে টাকা খরচ করা হয়নি। সড়ক নিরাপদ ও গতিশীল করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিডিএর একাধিক কর্মকর্তা বলেন, সিডিএ চেয়ারম্যান কারও মতামতকেই গুরুত্ব দেননি। তাঁর ইচ্ছাতেই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয়েছে।

এই বিভাগের আরও পড়ুন