আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবের কারণে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স (এনডিই) নামক একটি প্রতিষ্ঠান সড়ক ঠিকাদারির ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব সাফল্যের নজির স্থাপন করেছে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করার পর, মাত্র ছয় বছরের মধ্যে তারা একক এবং যৌথভাবে ৮,৫০০ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে, যা মোট সড়ক ঠিকাদারি কাজের ১০ শতাংশ।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সাতজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এনডিই ঠিকাদারি কাজ পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের প্রভাব কাজে লাগাত। কর্মকর্তাদের মতে, ওবায়দুল কাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে প্রতিষ্ঠানটির পেছনে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাক্তন সামরিক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক।
২০১১-১২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) কর্তৃক সড়ক ও সেতু নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে ৮৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করা হয়েছে। এই ব্যয়ের ৯০ শতাংশেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার কাজ পেয়েছে মাত্র ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হকের মতে, ঠিকাদাররা ঠিকাদারি কাজ পেতে, নিম্নমানের কাজ করে অর্থ আত্মসাৎ করতে এবং অতিরিক্ত কাজ দেখিয়ে বাড়তি বিল আদায় করতে মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘুষ দিতেন। তিনি আরও বলেন যে, বিগত সরকারের আমলে এই ঘুষ একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ ছিল এবং এটি দুর্নীতির মহামারি আকার ধারণ করেছিল।
সওজের তালিকাভুক্ত প্রায় ১ হাজার ১০০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও মাত্র ১৫টি প্রতিষ্ঠান কীভাবে ৯০ শতাংশ কাজ পেয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সওজের প্রকৌশলীদের মতে, এই ১৫টি প্রতিষ্ঠান সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’ ছিল।
অন্যদিকে, কিছু ঠিকাদার দাবি করছেন যে, আওয়ামী লীগ নেতাদের আশীর্বাদের পাশাপাশি মন্ত্রণালয় ও সওজের কর্মকর্তাদের ‘কমিশন’ দিতে হতো। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যদি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব তদন্ত করে, তাহলে তাদের অবৈধ আয়ের প্রমাণ বেরিয়ে আসবে।
এই ১৫টি প্রতিষ্ঠান হলো: হাসান টেকনো বিল্ডার্স, রানা বিল্ডার্স, এনডিই, মোজাহার এন্টারপ্রাইজ, মো. মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড, তাহের ব্রাদার্স, মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড, মাসুদ হাইটেক ইঞ্জিনিয়ার্স, স্পেক্ট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স, এম/এস সালেহ আহমেদ, এম এম বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ার্স, রিলায়েবল বিল্ডার্স, তমা কনস্ট্রাকশন, মাহফুজ খান লিমিটেড ও আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশন।
ঠিকাদারি কাজ পেতে জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে চলতি বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৫টি প্রতিষ্ঠানকে ছয় মাস থেকে দুই বছরের জন্য কালোতালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখিত ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি (স্পেক্ট্রা ও এম এম বিল্ডার্স ছাড়া) কালোতালিকাভুক্ত।
সওজ সূত্রের তথ্যানুসারে, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে সড়কের ঠিকাদারি কাজ মূলত তিনটি পক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল: ১. আওয়ামী লীগের কিছু প্রভাবশালী নেতা ও সংসদ সদস্য, ২. সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজনরা, এবং ৩. সওজের কিছু প্রকৌশলী। ২০১১ সালে ওবায়দুল কাদের সড়কমন্ত্রী হওয়ার পর ধীরে ধীরে ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা, তাঁর স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদের এবং নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর একটি শক্তিশালী গোষ্ঠী তৈরি হয়।
২০২১ সালে কাদের মির্জা প্রকাশ্যে তাঁর ভাই, ভাবি এবং একরামুল করিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন, যা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। সাবেক সড়কমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, ঠিকাদারি কাজের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে কাদের মির্জার সাথে ওবায়দুল কাদের এবং তাঁর স্ত্রীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে, কিছু সময় পর দুই ভাইয়ের মধ্যে বিরোধ মিটে যায়। মন্ত্রণালয় এবং সওজে পুনরায় তদবিরের সুযোগ ও ঠিকাদারি কাজ পেয়ে কাদের মির্জা আবার চুপ হয়ে যান।
সড়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান মন্তব্য করেছেন যে, পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে কোন ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হবে তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে ব্যবহার করা হত। তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, এই ধরণের অনিয়ম আর চলবে না। ঠিকাদারি প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে। অতীতে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত পরিচালনার বিষয়টিও তিনি বিবেচনা করছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব: মামা-ভাগনে ঠিকাদারের দখলে সড়কের হাজার কোটি টাকার কাজ!
গত ১২ বছরে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ পেয়েছে হাসান টেকনো বিল্ডার্স। প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ১১ হাজার ১১৮ কোটি টাকার কাজ। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রানা বিল্ডার্স, যারা পেয়েছে ১০ হাজার ৯১১ কোটি টাকার কাজ।
এই দুই প্রতিষ্ঠানের মালিক হলেন যথাক্রমে নাজমুল হাসান ও মো. আলম। তারা দুজন মামা-ভাগনে। বাড়ি কুমিল্লায়। নাজমুল হাসান কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।
জালিয়াতির অভিযোগে হাসান টেকনো ও রানা বিল্ডার্স – দুটি প্রতিষ্ঠানই বর্তমানে নিষিদ্ধ ঘোষিত।
অভিযোগ অস্বীকার করে হাসান টেকনোর মালিক নাজমুল হাসান দাবি করেন, তারা সব কাজ প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কম দামে পেয়েছেন। বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিও তিনি অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে, রানা বিল্ডার্সের মালিক মো. আলম বলেন, তিনি চার দশক ধরে সওজে ঠিকাদারি করছেন। যোগ্যতার ভিত্তিতেই তিনি কাজ পেয়েছেন। যৌথভাবে কাজ করতে গিয়ে অন্য ঠিকাদারের ভুলে তিনি নিষিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেন তিনি।
মো. আলমের ভাতিজা জুলফিকার হোসেনের (মাসুদ রানা) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম মাসুদ হাইটেক। এই প্রতিষ্ঠানটি ৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে এবং সবচেয়ে বেশি টাকার কাজ পাওয়া ঠিকাদারের মধ্যে অষ্টম স্থানে রয়েছে।
জুলফিকারের সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ জুয়েল এবং নারায়ণগঞ্জের আলোচিত-সমালোচিত সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সখ্য রয়েছে বলে সওজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এনডিই: ছয় বছরেই শীর্ষ ঠিকাদার, পেছনে আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাব?
মাত্র ছয় বছরের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) শীর্ষ ঠিকাদারদের তালিকায় তৃতীয় স্থান দখল করেছে এনডিই। সওজের তথ্য অনুযায়ী, জাল ও ভুয়া নথি জমা দিয়ে ঠিকাদারি কাজ নেওয়ার অভিযোগে গত ৬ জুলাই ছয় মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এই প্রতিষ্ঠানটিকে।
নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা করে এনডিই। আদালত নিষিদ্ধাদেশের উপর স্থগিতাদেশ দেন।
সাগর ইনফো বিল্ডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কে ৩৯টি কাজ করেছে। সওজ সূত্র জানায়, এই সবকটি কাজই এনডিইর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পন্ন করেছে তারা। এক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা তারিক আহমেদ সিদ্দিকের আশীর্বাদ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনডিইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক রায়হান মুস্তাফিজ বলেন, “আমরা ব্যবসায়ী, তারিক সিদ্দিককে লাগে না। খালেদা জিয়াও আমার আত্মীয়।” তিনি দাবি করেন, তার প্রতিষ্ঠানটি ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রথমে গণপূর্তের কাজ বেশি করত। পরে সওজে কাজ শুরু করে। সরকারি প্রাক্কলনের চেয়ে কম টাকায় দরপত্র দাখিল করে তারা কাজ পেয়েছে।
তবে অভিযোগ রয়েছে, সওজে যাদের কাজ দেওয়ার চেষ্টা থাকে, তাঁদের সরকারি প্রাক্কলন আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী তারা দরপত্র দাখিল করে কাজ পায়। এছাড়াও, দরপত্রের শর্ত পছন্দের ঠিকাদারের যোগ্যতার সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।
সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে মোজাহার এন্টারপ্রাইজের মালিক কাজী মোজাহারুল ইসলাম। বাগেরহাটের সাবেক সংসদ সদস্য ও শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই শেখ হেলাল উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত তিনি। মোজাহার এন্টারপ্রাইজ ৬ হাজার ৫৩১ কোটি টাকার কাজ করেছে, যার বড় অংশ খুলনা অঞ্চলে।
সওজের কাজ ভাগাভাগি: মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড পঞ্চম, এম এস সালেহ আহমেদ দশম স্থানে
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের কাজ বণ্টনে শীর্ষ স্থান অর্জনকারীদের তালিকায় মঈনউদ্দিন (বাঁশি) লিমিটেড পঞ্চম স্থানে রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি ৬,৪৬৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। সপ্তম স্থানে থাকা মোহাম্মদ আমিনুল হক লিমিটেড ৪,৫৪৯ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। সওজ সূত্রে জানা যায়, এই দুই ঠিকাদার সওজের কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে কাজ আদায় করতেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নেতাদেরও ব্যবহার করতেন।
সর্বোচ্চ কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দশম স্থানে রয়েছে এম এস সালেহ আহমেদ, যারা ২,৯৫৯ কোটি টাকার কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক সালেহ আহমেদ (বাবুল), যিনি ফেনীর সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। সওজের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত নিজাম হাজারীই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন।
এছাড়া রিলায়েবল বিল্ডার্স ২,৩৪৪ কোটি টাকার কাজ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক শফিকুল আলম (মিথুন), যিনি সর্বোচ্চ কাজ পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় ১২তম স্থানে রয়েছেন। শফিকুল আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। সওজ সূত্র জানায়, শেখ সেলিমের প্রভাবের কারণে গত নভেম্বরে গোপালগঞ্জে ১৩৭ কোটি টাকার এবং ঢাকায় গত বছরের অক্টোবরে ২৪২ কোটি টাকার কাজ পেয়েছিলেন শফিকুল। ঢাকার কাজটিতে তাঁর অংশীদার ছিলেন তাঁর বাবা শামসুল আলম, যিনি ওরিয়েন্ট ট্রেডিং অ্যান্ড বিল্ডার্স পরিচালনা করেন।
সংস্থার দুজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রিলায়েবলের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ উঠার পর চলতি বছরের শুরুতে প্রতিষ্ঠানটিকে কালোতালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেখ সেলিম কয়েক দফা ফোন করে সেই উদ্যোগটি বাধাগ্রস্ত করেন।
এছাড়া ঠিকাদারি কাজ আদায়ের জন্য মডেলদের ব্যবহার করে তদবির করার অভিযোগও রয়েছে। ২০২১ সালে একজন মডেলের কাছ থেকে একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি জব্দ করা হয়, যার নিবন্ধন ছিল রিলায়েবল বিল্ডার্সের নামে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান
সবচেয়ে বেশি কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের মধ্যে ১৩তম অবস্থানে রয়েছে তমা কনস্ট্রাকশন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রেল, স্থানীয় সরকার, গণপূর্ত, নৌসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে বিপুল পরিমাণ কাজ পেয়ে আলোচনায় উঠে আসে এই প্রতিষ্ঠানটি।
প্রতিষ্ঠানটির মালিক আতাউর রহমান ভূঁইয়া নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি বিগত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করে পরাজিত হন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজমের তমা কনস্ট্রাকশনের সাথে যুক্ত থাকার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। যদিও আতাউর রহমান সবসময় এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন।
গত ১২ বছরে সড়ক ও জনপথ বিভাগ থেকে তমা কনস্ট্রাকশন প্রায় ২ হাজার ৩০৯ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবে সওজের কাজ: তমা কনস্ট্রাকশন ও মাহফুজ খান লিমিটেডের অবস্থান
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, তমা কনস্ট্রাকশনের মালিক আতাউর রহমানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা মির্জা আজম, সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং নোয়াখালীর সাবেক সংসদ সদস্য একরামুল করিম চৌধুরীর সুসম্পর্ক ছিল। এর ফলে ওবায়দুল কাদের মন্ত্রী হওয়ার পর তমা বেশ কিছু সওজের কাজ পায়। তবে ২০২০ সালের শেষের দিকে ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে একরামুল করিম চৌধুরীর সম্পর্ক খারাপ হলে, ওবায়দুল কাদের আতাউর রহমানকে একরামের লোক আখ্যা দিয়ে তাঁকে সওজের কাজ না দেওয়ার নির্দেশ দেন কর্মকর্তাদের। তবে বছর দেড়েকের মধ্যে তাঁদের মধ্যকার মনোমালিন্য দূর হয় এবং তমা পুনরায় সওজের কাজ পেতে শুরু করে।
সর্বোচ্চ কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের তালিকায় ১৪তম অবস্থানে রয়েছে মাহফুজ খান লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ২,২৮১ কোটি টাকার কাজ করেছে। মাহফুজ খান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং তাঁর ছেলে সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকার সময় সাদিক আবদুল্লাহর মাধ্যমে সিটি করপোরেশনের কাজ নিয়ন্ত্রণ করতেন মাহফুজ খান।
আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের উত্থান: জাল সনদে হাজার কোটি টাকার কাজ!
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের অবস্থান বর্তমানে ১৫তম। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে এই প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ৯১৪ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আবেদ মনসুরের বাড়ি নোয়াখালীতে। তিনি পূর্বে বিলবোর্ড, ব্যানার ও বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করতেন এবং টেলিভিশন নাটকও প্রযোজনা করেছেন।
সূত্র জানায়, সে সময় সাবেক সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ফেসবুকে ওবায়দুল কাদের ও আবদুল কাদের মির্জার সঙ্গে তার একান্ত অনেক ছবি দেখা যায়। ২০১৮ সালের দিকে আবেদ মনসুর সওজে ঠিকাদারি শুরু করেন। সেই সময় ওবায়দুল কাদের সড়কে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন এবং আবেদ মনসুরকে তার সঙ্গে দেখা যেত। পরে আবেদ মনসুর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কৃষি ও সমবায়বিষয়ক উপকমিটির সদস্য হন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১৭ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছিলেন।
সওজের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, শুরুতে আবেদ মনসুর অভিজ্ঞতার জাল সনদ জমা দিয়ে কাজ পেয়েছেন। এ বিষয়ে আবেদ মনসুর কনস্ট্রাকশনের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সওজে জে এন্টারপ্রাইজের উত্থান: শেখ হাসিনার ‘পিয়নের’ প্রভাব?
সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ তালিকায় না থাকলেও জে এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে। সওজ সূত্র জানায়, সাম্প্রতিককালে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ১৯৭ কোটি টাকার ১০টি কাজ পেয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানটির পেছনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচিত ‘পিয়ন’ জাহাঙ্গীর আলম রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জে এন্টারপ্রাইজ কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যেমন ওবায়দুল কাদের, কাদের মির্জা, নিজাম উদ্দিন হাজারী, একরামুল করিম চৌধুরী, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, এবং বাহাউদ্দিন বাহার আত্মগোপনে চলে যান। ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী ইশরাতুন্নেছা কাদেরের বক্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তাঁর সন্ধান মেলেনি।
কিছু শীর্ষ ঠিকাদার নিজেদের বঞ্চিত বলে দাবি করেছেন। এই ঠিকাদাররা গত ১৮ আগস্ট সওজের প্রধান প্রকৌশলী বরাবর ১০ দফা দাবিসম্বলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেছেন। ৯ জন ঠিকাদার এই স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন, যাদের মধ্যে ৫ জন সওজের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়ে থাকেন। এই ঠিকাদারদের প্রতিষ্ঠানগুলো হলো: হাসান টেকনো বিল্ডার্স, এনডিই, রিলায়েবল বিল্ডার্স, মাসুদ হাইটেক, এম এস সালেহ আহমেদ।
ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করার দায়িত্বে থাকা সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদকে গত মাসের শুরুতে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়েছে। ঠিকাদারদের ১০ দফা দাবীর মধ্যে এই কর্মকর্তাকে বদলি করার দাবিও ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রভাবে সওজে দুর্নীতি: দুদকের সুপারিশে কান দেয়নি সড়ক মন্ত্রণালয়
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে (সওজ) দুর্নীতির উৎস ও কারণ প্রতিরোধে ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেশ কিছু সুপারিশসহ প্রতিবেদন সড়ক মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সুপারিশ বাস্তবায়নে সড়ক বিভাগকে নির্দেশনা দিলেও তাতে কান দেয়নি সড়ক মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, গত এক যুগে সওজ ৪০ হাজারের বেশি দরপত্র আহ্বান করেছে। এর মধ্যে সাড়ে ৩৬ হাজার দরপত্রের মূল্য ছিল প্রতিটি এক লাখ থেকে এক কোটি টাকার মধ্যে। এতে মোট ব্যয় ছিল প্রায় ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। সূত্র বলছে, অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট এই কাজের নামে আসলে লুটপাট করা হয়।
বাকি চার হাজারের মতো দরপত্রের মূল্য ছিল প্রতিটি ১ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা বা তার বেশি। তিনজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেকোনো প্রকল্পে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্থ আওয়ামী লীগ নেতাদের ও প্রকৌশলীদের কমিশন দিতে ব্যয় হয়। মাঠপর্যায়ের কর্মীদের ঘুষ ও চাঁদার পেছনেও অর্থ ব্যয় হয়।
এ প্রসঙ্গে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহিরুল হক বলেন, ঘুষ গ্রহণ, কাজ পেতে অবৈধভাবে সহায়তা করা ও জালিয়াতির সুযোগ করে দেওয়ার দায়ে সওজের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কড়া শাস্তি হওয়া উচিত। তিনি বলেন, এর জন্য একটা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র তদন্ত করা জরুরি।