পাহাড় ও বন ধ্বংস করে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৩৬টি ইটভাটার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়ন। ইটভাটার উত্তাপ আর ধুলাবালিতে অতিষ্ঠ পার্শ্ববর্তী দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী। পরিবেশ অধিদপ্তরের মতে, এত ছোট এলাকায় এত ইটভাটা দেশের আর কোথাও নেই।
ফাইতং সহ পার্বত্য এলাকায় মোট ১১৯টি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। বান্দরবানের ৪৪টির মধ্যে ৩৬টিই ফাইতংয়ে। রাঙামাটিতে ২৯টি এবং খাগড়াছড়িতে ৪৬টি ইটভাটা রয়েছে। এসব ভাটায় নিয়মিত অভিযান চালানো হলেও স্থায়ীভাবে উচ্ছেদ করা হয় না।
পাহাড় কেটে, ড্রাম চিমনি ব্যবহার করে, বনের কাঠ পুড়িয়ে এসব ইটভাটা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। অভিযোগ রয়েছে, মালিকদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত নেতাসহ ব্যবসায়ীরা থাকায় এবং আদালতে রিট করে স্থগিতাদেশ নেওয়ায় ভাটাগুলো বন্ধ করা যাচ্ছে না।
হাইকোর্ট ৫ জানুয়ারি জেলা প্রশাসকদের অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে এক সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)-এর রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট অবৈধ ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেন। কিন্তু যথাযথ উচ্ছেদ অভিযান না হওয়ার অভিযোগ এইচআরপিবির।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বান্দরবান সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম জানান, “এখানে কোনো ইটভাটার বৈধতা নেই। আমরা অভিযান চালালে তারা আদালতের আদেশ দেখিয়ে কার্যক্রম চালায়।”
ফাইতংয়ের শিবাতলী পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে ৫টি ইটভাটা। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ইটভাটার ধোঁয়া ও ধুলায় অতিষ্ঠ। একই অবস্থা রোয়াজাপাড়া মৈত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
২০ জানুয়ারি ফাইতংয়ে ৪টি ইটভাটাকে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুপায়ন দেব জানান, অভিযান অব্যাহত থাকবে।
ফাইতং ব্রিকফিল্ড মালিক সমিতির সভাপতি মোকতার আহমদ বলেন, “আমাদের কাছে আদালতের আদেশ রয়েছে। তবুও প্রশাসন অভিযান চালায়। গাছ কাটা ও পাহাড় কাটার জন্য জরিমানা করছে।”
খাগড়াছড়িতে ৪৬টি ইটভাটার মধ্যে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত মোহাম্মদ সেলিম, জেলা পরিষদের সাবেক দুই চেয়ারম্যান কংজুরি চৌধুরী ও মংসুইপ্রু চৌধুরী, সদর উপজেলার সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আকতার হোসেনের ইটভাটা রয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার ভাটা ছিল দীঘিনালা উপজেলায়।
রাঙামাটির কাউখালীতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বরের ইটভাটা রয়েছে। লংগদুতে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন ও ইউপি সদস্য আমিন হোসেনের ইটভাটা রয়েছে।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, পাহাড় বা টিলার আধা কিলোমিটারের মধ্যে, আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক কিলোমিটারের মধ্যে এবং বনাঞ্চলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ।
ইটভাটা পরিচালনায় পরিবেশ ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসন এবং বন বিভাগের অনুমতি প্রয়োজন। কিন্তু এসব ভাটার কোনোটাই নেই।
এইচআরপিবির আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলেন, “পাহাড়ে ইটভাটা স্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়ারও সুযোগ নেই। অভিযানের নামে জরিমানা করা হচ্ছে। কয় দিন পর এগুলো আবার চালু হবে। এই খেলা তো মানা যায় না।”
গবেষণায় দেখা গেছে, ইটভাটার কারণে বায়ু, মাটি, পানি দূষিত হয় এবং বনের গাছপালা নষ্ট হয়। ইটভাটার আশপাশের এলাকার মানুষ চর্ম, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হন।