বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদচট্টগ্রামচট্টগ্রাম বন্দর: দেশি টার্মিনালের আয় ২২ কোটি, বিদেশি পরিচালনায়...

চট্টগ্রাম বন্দর: দেশি টার্মিনালের আয় ২২ কোটি, বিদেশি পরিচালনায় মাত্র ৬ কোটি টাকা!

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের নতুন পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) গত বছর জুন থেকে সৌদি আরবের রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) পরিচালনা শুরু করলেও সাত মাস পরও টার্মিনালটির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য ছিল দক্ষতা বৃদ্ধি ও রাজস্ব আয় বাড়ানো, কিন্তু এখন পর্যন্ত পিসিটিতে মাত্র ৩৪টি জাহাজ ভিড়েছে এবং ৩০ হাজার রপ্তানি কন্টেইনার উঠানামা হয়েছে—যার বেশিরভাগই খালি কন্টেইনার। আমদানি পণ্যবাহী কোনো জাহাজই পিসিটিতে ভিড়েনি।

পিসিটি টার্মিনালের বার্ষিক ৫ লাখ কন্টেইনার পরিচালনার সক্ষমতা থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে এটির ব্যবহার সীমিত। বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, স্ক্যানার ও যন্ত্রপাতির অভাবে আমদানি কার্যক্রম শুরু হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক জানান, কাস্টমসের অনুমোদন পেলে আগামী দুই মাসের মধ্যে আমদানি কার্যক্রম শুরুর আশা করা হচ্ছে। তবে গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি পেতে আরও দেড় বছর লাগতে পারে বলে তিনি স্বীকার করেন।

রেড সি গেইটওয়ের সাথে ২২ বছরের চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি রপ্তানি কন্টেইনারের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৮ ডলার পায়। এ পর্যন্ত ৩০,৩৩৩ কন্টেইনারের বিনিময়ে বন্দরের আয় ৫.৪৬ লাখ ডলার (সাড়ে ৬ কোটি টাকা)। অন্যদিকে, দেশীয় টার্মিনালে একই পরিমাণ কন্টেইনার থেকে আয় হতো প্রায় ২২ কোটি টাকা (কন্টেইনার প্রতি ৬০ ডলার হারে)। এই ব্যবধান নিয়ে ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, পিসিটি পরিচালনায় রেড সি গেইটওয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক ইমেজ গড়তে চাওয়া হয়েছিল। তবে অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক বিবেচনায় সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক জোরদার করতে এই চুক্তি করা হয়েছে। কোনো দরপত্র ছাড়াই সরাসরি রেড সিকে দায়িত্ব দেওয়াকে অনিয়ম হিসেবে দেখছেন সমালোচকরা। বন্দরের এক কর্মকর্তা অবশ্য যুক্তি দেন, রেড সি ২৫ মিলিয়ন ডলার সিকিউরিটি জমা রেখেছে এবং ভবিষ্যতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বন্দরের অন্য টার্মিনালগুলো (এনসিটি, সিসিটি, জিসিবি) দেশীয় অপারেটরদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেখানে রাজস্ব আয় দেশেই থাকে। কিন্তু পিসিটির ক্ষেত্রে রেড সি জাহাজ কোম্পানির কাছ থেকে সরাসরি মাশুল আদায় করে, যার ৪২ ডলার বিদেশে চলে যায়। এনসিটি টার্মিনালও বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বন্দর শ্রমিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীরা প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

রেড সি গেইটওয়ে টার্মিনাল কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও বন্দর ব্যবহারকারীরা পিসিটির বর্তমান অবকাঠামো ও সেবাকে অপ্রতুল মনে করছেন। চৌধুরী গ্রুপের সাহেদ সারোয়ারের মতে, পিসিটিতে পণ্য পরিবহনে খরচ বেশি এবং জাহাজ মালিকরা সেখানে ভিড়াতে অনাগ্রহী। এদিকে, বন্দর কর্তৃপক্ষ আশাবাদী, যন্ত্রপাতি যোগ হলে টার্মিনালটির কার্যক্রম গতি পাবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পিসিটি চুক্তি সম্পাদিত হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এনসিটি টার্মিনালও বিদেশি অপারেটরের হাতে দেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ চলছে, যা বন্দরকেন্দ্রিক শ্রম অসন্তোষের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের রাজস্ব আয়ের হিসাব ফেললেও ব্যবহারকারী ও বিশেষজ্ঞদের মূল প্রশ্ন—বিদেশি অপারেটর দিয়ে পরিচালনার মাধ্যমে বন্দরের সামগ্রিক দক্ষতা ও আয় কীভাবে বাড়বে? পিসিটির বর্তমান অবস্থায় এই উদ্যোগের সুফল নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, বিদেশি অপারেটরের বিরোধিতা বন্দর ব্যবহারকারীরা করছেন না। তারা বলছেন, একটি রেডিমেড এবং বন্দরের হার্ট হিসেবে পরিচিত এবং সব যন্ত্রপাতি সংযোজিত এনসিটি কেন বিদেশিদের হাতে দেবে? নতুন একটা টার্মিনাল তৈরি করে সেটি পরিচালনার জন্য বিদেশিদের উম্মুক্ত করা হোক।

এই বিভাগের আরও পড়ুন