বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদলিডহামজা চৌধুরী: লাল-সবুজ জার্সিতে নতুন অধ্যায় শুরু

হামজা চৌধুরী: লাল-সবুজ জার্সিতে নতুন অধ্যায় শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ১৯শে ডিসেম্বর এক আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় জানিয়েছে যে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইংল্যান্ডপ্রবাসী ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী এখন থেকে বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলে খেলার অনুমতি পেয়েছেন। দীর্ঘ অপেক্ষা এবং নানা প্রক্রিয়ার পর আন্তর্জাতিক ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটির অনুমোদনের মাধ্যমে লেস্টার সিটির এই মিডফিল্ডারের জন্য বাংলাদেশের হয়ে খেলা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

হামজার বাংলাদেশ দলে যোগদানের প্রক্রিয়া সহজ ছিল না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন প্রথমবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল প্রায় চার-পাঁচ বছর আগে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব, বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রাপ্তি এবং ইংল্যান্ড ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অনুমোদনসহ নানা ধাপ পেরিয়ে এই স্বীকৃতি পেতে অনেকটা সময় লেগেছে।

চলতি বছর জুন মাসে হামজা চৌধুরী বাংলাদেশি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। এরপর অগাস্ট মাসে তার মা রাফিয়া চৌধুরী লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে পাসপোর্ট গ্রহণ করেন। পাসপোর্ট প্রাপ্তির পর লেস্টার সিটি এবং ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। সবশেষে ফিফার প্লেয়ার্স স্ট্যাটাস কমিটি চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করে।

এক ভিডিও বার্তায় হামজা বলেন, “শেষ ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। এখন আমি লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে আছি।”

হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশ দলে অভিষেক হতে পারে আগামী মার্চে ভারতের বিপক্ষে এশিয়ান কোয়ালিফায়ারের ম্যাচে। তবে তার আগে যদি কোনো প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়, সেখানেই হতে পারে তার প্রথম খেলা। নভেম্বরে মালদ্বীপের বিপক্ষে তার অভিষেকের সম্ভাবনা থাকলেও ফিফার অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং তার চোট সমস্যা তা বিলম্বিত করে।

হামজা চৌধুরীর যোগদানকে বাংলাদেশের ফুটবলে একটি নতুন অধ্যায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। সাবেক ফুটবলার এবং ফর্টিস ক্লাবের ম্যানেজার রাশেদুল ইসলাম মনে করেন, “হামজা যে মানের খেলোয়াড়, সেই মানের অন্য কোনো ফুটবলার বাংলাদেশের নেই। তিনি যে কোনো পজিশনে খেলতে সক্ষম এবং তার খেলার মান আমাদের ফুটবলে নতুন গতি আনবে।”

ক্রীড়া লেখক আশফাক উল মুশফিক বলেন, “হামজার মতো আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলার বাংলাদেশের ফুটবলে এক বিরল ঘটনা। তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দেশের ফুটবলের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।” তিনি আরও যোগ করেন, “হামজার স্টারডম এবং তার ফুটবল দক্ষতা দেশের ফুটবলে একটি জনস্রোত তৈরি করবে।”

হামজার আগমন শুধুমাত্র মাঠেই নয়, মাঠের বাইরেও একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাশেদুল ইসলাম বলেন, “হামজা আমাদের ড্রেসিংরুমে একটি পেশাদার মানসিকতা আনতে পারবেন। কীভাবে আন্তর্জাতিক মানের ফুটবলারদের জীবনযাপন এবং প্রস্তুতি নিতে হয়, তা তিনি আমাদের ফুটবলারদের শিখিয়ে যেতে পারবেন।”

হামজা চৌধুরীর মা রাফিয়া চৌধুরী বাংলাদেশের হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার স্নানঘাট ইউনিয়নের দেওয়ানবাড়ির বাসিন্দা। ছোটবেলায় হামজা প্রায়ই বাংলাদেশে আসতেন এবং দুই-তিন সপ্তাহ এখানে অবস্থান করতেন। সেই সময়ের স্মৃতি নিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে যা খুশি করতে পারতাম। রাতে ছোট বাচ্চারা ঘুরে বেড়াত। আমি বাংলা বলতে পারি, এটা জানলে মানুষ অবাক হতো।”

হামজার মা এবং সৎবাবা মুরশিদের ত্যাগের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমার মা খুব শক্তিশালী একজন নারী। তার শেখানো জীবনদর্শন আমার খেলোয়াড়ি জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে।”

ইসলাম ধর্মে গভীর বিশ্বাসী হামজা ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, “আমি ড্রেসিংরুম থেকে বের হওয়ার সময় আয়াত-উল-কুরসি এবং ছোট ছোট দোয়া পড়ি। এগুলো আমার মা আমাকে শিখিয়েছেন।”

লেস্টার সিটির যুব দল থেকে উঠে আসা হামজা চৌধুরী ২০১৭ সালে মূল দলে অভিষেক করেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ এবং এফএ কাপ জয়ী এই মিডফিল্ডার ব্রিটিশ-এশিয়ান কমিউনিটির মধ্যেও বিশেষভাবে পরিচিত। তার ঝাঁকড়া চুল এবং মাঠের দক্ষতা তাকে সহজেই চেনার মতো একটি বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।

২০১৯ সালে বিবিসি স্পোর্টসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমার মা সবসময় নতুন অভিজ্ঞতা নিতে আমাকে উৎসাহিত করতেন। তার সেই সিদ্ধান্তই আজ আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।”

হামজা চৌধুরীর বাংলাদেশ দলে যোগদান নিঃসন্দেহে দেশের ফুটবলের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তার আন্তর্জাতিক মানের অভিজ্ঞতা, পেশাদারিত্ব এবং স্টারডম দেশের ফুটবলের উন্নয়নে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। মাঠে এবং মাঠের বাইরে তার ভূমিকা বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

এই বিভাগের আরও পড়ুন