খাগড়াছড়ির প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে সরিষা চাষে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে, স্বল্প উৎপাদন খরচ এবং ভোজ্যতেল হিসেবে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় সরিষা চাষে ঝুঁকছেন তারা। যার ফলে পাহাড়ী এই জেলায় সরিষা চাষের সম্প্রসারণ ঘটছে। আবাদি-অনাবাদি জমিতে কৃষকরা এখন সরিষা চাষ করছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, এ বছর বিগত বছরগুলোর চেয়ে উৎপাদনও বেশি হবে। তবে, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণের অভাবে এ জেলার চাষিরা সরিষা ক্ষেত থেকে মধু উৎপাদন করতে পারছেন না। কৃষি বিভাগ এ ব্যাপারে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।
এ বছর খাগড়াছড়ি জেলায় সরিষা চাষে কৃষকরা সাফল্য অর্জন করেছেন। ধানের তুলনায় সরিষা চাষে লাভ বেশি বলে তাদের অভিমত। বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। খাগড়াছড়ির দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। পৌষের কনকনে হিমেল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে কৃষকের স্বপ্ন। সূর্যের কিরণ প্রতিফলিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই সরিষা ফুলের সমারোহে হেসে ওঠে চারদিক। নয়নাভিরাম এই দৃশ্য দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসছে অনেক মানুষ।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, বৃষ্টির আগে যারা চারা রোপণ করেছিলেন তাদের ফলন তেমন ভালো হয়নি, তবে বৃষ্টির পরে যারা রোপণ করেছেন তাদের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকে সহযোগিতা পেলে সরিষা চাষে আরো বেশি আগ্রহী হবেন এবং ব্যাপক ভাবে সরিষা চাষ হবে বলে মনে করেন তারা।
কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, জেলায় এবার ৫৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে, যার লক্ষ্যমাত্রাও ছিল ৫৫০ হেক্টর। এর মধ্যে বারি-১৪, বারি-১৮ এবং বিনা সরিষা-৯ জাতের সরিষা চাষ আবাদ হয়েছে। আগামী বছর সঠিক সময়ে বীজ সর্বরাহ করতে পারলে এ লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ছাড়িয়ে যাবে। খাগড়াছড়িতে এবার প্রতি হেক্টর থেকে ১.৬০ টন হারে মোট ৮ হাজার ৮ শত ৮০ টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। ২০২৫-২৬ মৌসুমের মধ্যে জেলায় ৫০ ভাগ অধিক জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক, মোহাম্মদ বাছিরুল আলম জানান, সরিষা চাষ শুরুর সময় (অক্টোবর-নভেম্বর) বৃষ্টি থাকায় চাষাবাদে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। সরিষার আবাদ বৃদ্ধি করা গেলে সরিষার তেলের চাহিদা পূরণে আরও বেশি ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে। এ বছর সরিষা আবাদে ১০০ বিঘা জমিতে প্রণোদনা দেয়া হয়েছে এবং রাজস্ব বিভাগের প্রকল্পে ১০০ বিঘা জমিতে প্রদর্শনী প্লট করা হয়েছে। বিগত বছরে যারা প্রদর্শনী প্লট করেছে তারা এবার ২০০ বিঘা জমিতে ফলোআপ আবাদ করেছে। ভবিষ্যতে আরও বেশি জমিতে সরিষা চাষ হলে অচিরেই সরিষার জমিতে মৌমাছির বাক্স বসিয়ে পরাগায়নের মাধ্যমে ফলন বাড়ানো যাবে এবং মধু আহরণ করা যাবে। জমিতে সরিষার চাষ করলে সরিষার ফুল ও সরিষা ঝরে পড়ে মাটিতে মিশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, যা পরবর্তীতে রোরো আবাদে অধিক ফলন পেতে সার হিসেবে সাহায্য করে।
খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুক্তা চাকমা বলেন, সদর উপজেলায় ৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আবাদ হয়েছে ৪৫ হেক্টর। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও চাষাবাদ বিগত বছরগুলোর চেয়ে বেড়েছে। কৃষি বিভাগের প্রণোদনা এবং বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে চলতি মৌসুমে কৃষকরা সরিষা চাষে আগ্রহী হয়েছেন। মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা সরিষার আবাদে ঝুঁকেছেন। ফলে বেড়েছে আবাদ, বাড়বে উৎপাদন।
প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমন তোলার পরপরই সরিষা বপন করা হয়েছে। কম খরচে বেশি ফলন হওয়ায় সরিষা চাষে তাদের আগ্রহ বেড়েছে।
জেলা সদরের কমলছড়ি এলাকার কৃষক অসিত বরন চাকমা বলেন, ইরি-বোরো চাষে খরচ বেড়ে যাওয়ায় বোরো আবাদে আগে খরচ পোষাতেই সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন এখানকার কৃষকরা। নতুন জাতের বারি সরিষা-১৪ রোপণে উৎসাহিত করায় কৃষকরা ভালো ফলন পাচ্ছেন। প্রতি হেক্টরে প্রায় দুই টন ফলন হয় এ সরিষায়।
জেলার মানিকছড়ি উপজেলার বড় পিলাক এলাকার চাষী আফসার হোসেন জানান, এক একর জমিতে বোরো চাষে খরচ পড়ে ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা, আর ফলন পাওয়া যায় ২৮ থেকে ৩০ হাজার টাকার। একই জমিতে সরিষা চাষে খরচ পড়ে মাত্র ৫ হাজার টাকা। খরচ বাদে একর প্রতি কৃষকদের লাভ থাকে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা। জমিতে এক কেজি সরিষার বীজ বপন করে তিন কেজি সরিষা পাওয়া যায়।