চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশের অন্যতম আলোচিত এই মেগা প্রকল্পে বহু প্রতীক্ষিত কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনের নির্মাণ কাজ নিয়েও চলছে বিশ্লেষণ এবং পর্যবেক্ষণ।
দুই দিনব্যাপী সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে রেললাইন প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখেন সরকারি রেল পরিদর্শক (জিআইবিআর) ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদ। ১০১ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ এবং কক্সবাজার স্টেশনের বিভিন্ন অংশে তিনি সরাসরি পরিদর্শন করে বিভিন্ন ত্রুটি তুলে ধরেন এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের কাছে এর কারণ ও সমাধান নিয়ে আলোচনা করেন।
বিশেষত, আইকনিক স্টেশনের ডিজাইনে থাকা বড় ত্রুটি নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বর্ষাকালে স্টেশনের শেড থেকে পানি চুইয়ে প্লাটফর্মে পড়ার কারণে যাত্রীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
মঙ্গলবার (৫ নভেম্বর) দুই দিনের সফরে দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্পে যান সরকারি রেল পরিদর্শক ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদ। প্রথম দিনে তিনি দোহাজারী থেকে চকরিয়া পর্যন্ত প্রায় ৫৩ কিলোমিটার রেলপথ ট্রেনে করে পরিদর্শন করেন। দ্বিতীয় দিনে (৬ নভেম্বর) তিনি চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অবশিষ্ট রেলপথ এবং কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশনের নির্মাণ কাজ খতিয়ে দেখেন। এই স্টেশনটি দেশের একমাত্র আইকনিক স্টেশন হিসেবে নির্মিত হয়েছে, যার নির্মাণ ব্যয় প্রায় ২১৫ কোটি টাকা।
বর্ষা মৌসুমে বিপত্তি
পরিদর্শনকালে ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদ জানান, স্টেশন বিল্ডিংয়ের শেড থেকে বর্ষাকালে পানি চুইয়ে প্লাটফর্মে পড়ার ঘটনাটি একটি বড় ধরনের নকশাগত ত্রুটি। তিনি বলেন, “এতো উঁচু করে স্টেশনের শেড ডিজাইন করা হয়েছে যে বর্ষার সময় পানির চুইয়ে প্লাটফর্মে এসে পড়ছে। এমনকি যাত্রীদের গায়ে এই পানি পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” এ অবস্থায় তিনি এই ত্রুটিকে একটি গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং একে একটি বড় ধরনের গঠনগত ক্রটি হিসেবে অভিহিত করেন।
প্রকল্পের ডিজাইনের ত্রুটি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদ বলেন, “ডিজাইনের মধ্যে সমস্যা ছিল। বাংলাদেশের বাস্তবতার নিরিখে, এ ধরনের প্রকল্পে আরো বাস্তবসম্মত চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন ছিল। এই ত্রুটি সম্পর্কে প্রকল্প পরিচালক ও ঠিকাদারী সংস্থার প্রতিনিধিদের জিজ্ঞেস করলে তারা জানান, ‘ডিজাইন যেভাবে করা হয়েছে তারা সেইভাবে কাজ সম্পন্ন করেছেন।’”
কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন বিল্ডিংয়ে অসম্পূর্ণতা
ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদ জানান, আইকনিক স্টেশন ভবনের নির্মাণ কাজ এখনো শেষ হয়নি। স্টেশনের হোটেল রুমগুলোতে কিছু কাজ এখনও বাকি আছে, যেমন ইন্টেরিয়র ডিজাইন, ফার্নিচার সেটআপ, লাইটিং, এবং জেনারেটর ব্যবস্থা। এসব অসম্পূর্ণ কাজের জন্য যাত্রীদের সুবিধা প্রাপ্তিতে আরও বিলম্ব হতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। প্রকল্প পরিচালক এবং ঠিকাদার সংস্থার প্রতিনিধিরা তাকে জানিয়েছেন যে, এই অসম্পূর্ণ কাজগুলো দ্রুত শেষ করা হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা সম্পন্ন করা হবে। এই মেগা প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ হলে দেশের পর্যটন শিল্পে এর বিশেষ প্রভাব পড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
মেগা প্রকল্পের ত্রুটি ও বিচ্যুতি
দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পটি দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার এক বড় সফলতা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে এতো বিশাল একটি প্রকল্পে একাধিক ত্রুটি এবং বিচ্যুতি ধরা পড়েছে। কক্সবাজার স্টেশনের ছাদ থেকে প্লাটফর্মে পানি পড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটির কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিভিন্ন মহলে প্রকল্পের কাজ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
এর আগে এমন বড় প্রকল্পে নকশাগত ত্রুটির কারণে ভবিষ্যতে অনেক বড় সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা। সাধারণত এমন ধরনের প্রকল্পে প্রতিটি দিক বিবেচনা করেই কাজ করা উচিত হলেও, এখানে সে ধরনের যথাযথ পরিকল্পনার অভাব দেখা গিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
রিপোর্টের গুরুত্ব
সরকারি রেল পরিদর্শকের এই পরিদর্শন রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তার রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ কিস্তির টাকা ছাড় দেয়া হবে। এই রিপোর্টে যদি উল্লেখিত ত্রুটি এবং অসঙ্গতি তুলে ধরা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর চাপ তৈরি হবে ত্রুটিগুলো সমাধান করতে এবং ভবিষ্যতে আরও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ এগিয়ে নিতে।
ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদ বলেছেন, আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তিনি তার রিপোর্ট জমা দেবেন, যেখানে এসব ত্রুটি সংশোধনের জন্য সুপারিশ থাকবে।
পর্যটনের জন্য সম্ভাবনার দ্বার
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথটি দেশের পর্যটনশিল্পের জন্য এক অনন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। রেললাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে যাত্রী পরিবহন সহজ হওয়ার পাশাপাশি দেশের পর্যটকদের জন্য কক্সবাজার ভ্রমণ আরও আরামদায়ক হবে। বর্তমানে ঢাকা থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম হয়ে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন কক্সবাজারে যাচ্ছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের একটি বিশেষ ট্রেনও পরিচালনা করা হচ্ছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এই মেগা প্রকল্পের কাজের সুচারু সমাপ্তি যেমন দেশের পর্যটন শিল্পকে উজ্জ্বল করবে, তেমনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় আরও সতর্কতা অবলম্বন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ আহমেদের সুপারিশ অনুযায়ী, কক্সবাজার স্টেশনের শেডের ডিজাইন সংশোধন করলে যাত্রীদের নিরাপত্তা এবং আরাম নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এছাড়া, অন্যান্য ত্রুটিগুলো দ্রুত সমাধান করলে এটি দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী উন্নয়ন হিসেবে বিবেচিত হবে।
এই প্রকল্পটি কেবল রেল যোগাযোগের জন্য নয়, বরং দেশের পর্যটন শিল্পের জন্যও এক বিশাল মাইলফলক হয়ে থাকবে। তবে, এ ধরনের প্রকল্পে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি যেন না থাকে, সে বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি বলে মত প্রকাশ করেছেন অনেকেই।