চট্টগ্রামের অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত কর্ণফুলী নদী আজ চরম সংকটের মুখে। প্রায় চারশ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং নিয়মিত ড্রেজিং করা সত্ত্বেও নদীটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। দখল, দূষণ ও ভরাটের কারণে নদীটির অবস্থা বেহাল। গভীরতা কমার পাশাপাশি প্রস্থও ছোট হয়ে আসায় নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
তিন শতাধিক কলকারখানা, ৭০ লক্ষ নগরবাসীর বর্জ্য এবং পলিথিন কর্ণফুলীর সর্বনাশ করছে। অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্যে নদী ও এর প্রাণবৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। ২৭০ কিমি দীর্ঘ এই নদী শুধু চট্টগ্রামের প্রধান নদীই নয়, এটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। চট্টগ্রাম বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রবন্দর এই নদীর নাব্যতার উপর নির্ভরশীল।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দশ বছর আগে ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতু এলাকা ও চাক্তাই খালের মুখে কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিল প্রায় ৯০০ মিটার, যা বর্তমানে ৪৩০ থেকে ৫১০ মিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। নদীর দুই পাড়ে বছরের পর বছর ধরে অবৈধ দখলের কারণে স্থাপনা ও অবকাঠামো গড়ে ওঠায় নদীর স্বাভাবিক গতিশীলতা ও প্রবাহ নষ্ট হচ্ছে। এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের পাশাপাশি কিছু অংশ মরে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নদীতীরে চর জেগে ওঠায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম মহানগরীর ৩৬টি খাল ও নালা দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার ২০০ টন বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ছে। নগরীর ৫২টি খাল ও নালার মধ্যে বর্তমানে ৩৬টির মতো কোনোমতে টিকে আছে, যেগুলোর মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বর্জ্য কর্ণফুলীতে গিয়ে মিশছে। এছাড়া, নদীর দুই পাড়ের তিন শতাধিক কারখানা নিয়মিত নদী দূষণ করছে, যাদের অনেকেই নদী ভরাটের সাথে জড়িত। নগরীর ৭০ লক্ষ মানুষের বর্জ্য ও পলিথিন কর্ণফুলীর তলদেশে বিশাল পলিথিনের স্তূপ তৈরি করেছে, যা নদী ও এর জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
চট্টগ্রামের নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক আলীউর রহমান জানান, ২০১৯ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে ভূমি মন্ত্রণালয় কর্ণফুলী নদীর তীরের ২০৮১টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা প্রকাশ করলেও জেলা প্রশাসন সেগুলো উচ্ছেদে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এমনকি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্ণফুলী ভরাট করে গড়ে ওঠা মেরিনার্স পার্ক মাঠ ইজারা দেওয়ার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, যার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করা হয়েছে।
অন্যদিকে, কর্ণফুলী প্রতিনিয়ত দূষণের শিকার হচ্ছে। নগরীর খাল ও কলকারখানার বর্জ্য এবং জাহাজের পোড়া তেল নদীর পানিকে দূষিত করছে। ২০১৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিটি খালের মুখে পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ১ মিলিগ্রামের নিচে, যা মাছের বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট নয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো নগরীর পলিথিন বর্জ্য কর্ণফুলীতে মেশার কারণে নদীর তলদেশে পলিথিনের বিশাল স্তর জমেছে। পলিথিন সহজে রিসাইকেল করা যায় না এবং এগুলো নদী থেকে সাগরে গিয়ে মাছের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করছে। এমনকি সাগরের তিমি মাছও পলিথিনের প্রভাবে মারা যাচ্ছে, যা মানবদেহের জন্যও মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনছে।
কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হলে হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। শাহ আমানত সেতুর নিচ থেকে চাক্তাই খালের মোহনা পর্যন্ত জেগে ওঠা চর খনন করে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। এছাড়াও, শাহ আমানত সেতুর ৩ ও ৪ নম্বর পিলারের নিচে সৃষ্ট গর্তে বোল্ডার ফেলে মাটি ক্ষয় রোধ করতে হবে এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত স্ট্র্যাটেজিক মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ করে নদী খনন করতে হবে।