রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদটপ নিউজ১৫ বছরে ১৯২৬ জনকে হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কি রাজনৈতিক...

১৫ বছরে ১৯২৬ জনকে হত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কি রাজনৈতিক হাতিয়ার?

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস দীর্ঘ এবং সংবেদনশীল। এ বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৪ সালে, যখন র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) যাত্রা শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে এই বাহিনীকে সন্ত্রাস ও মাদকবিরোধী অভিযানে পাঠানো হয়, যা ক্রমশ ক্রসফায়ারের ঘটনায় পরিণত হয়। এরপর থেকে ক্রসফায়ার বাংলাদেশে একটি আলোচিত ও সমালোচিত শব্দে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তকমা যুক্ত হয়েছে।

ক্রসফায়ার নিয়ে বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা ঘটনাগুলোর তথাকথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’। এতে বলা হয় যে অভিযুক্তরা পুলিশের দিকে গুলি বা বোমা নিক্ষেপ করেছেন, আর পুলিশ আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালিয়েছে, যার ফলে অভিযুক্তের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ও সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ বলছে ভিন্ন কথা। মানবাধিকার সংগঠন ও সংশ্লিষ্টদের মতে, অনেক ঘটনাই সাজানো এবং নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ডের শামিল।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, আওয়ামী লীগের আমলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে অন্তত ১,৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এই তথ্য প্রকাশিত হয় সংবাদপত্র ও মিডিয়া প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে। ২০১৫ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রেকর্ড অনুযায়ী ক্রসফায়ারে নিহতের সংখ্যা ১,২৯৩ জন। এসব ঘটনায় প্রতিটি বিভাগেই প্রায়শই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, আর কোনো জেলাই এই তালিকার বাইরে নয়।

কক্সবাজারের মতো জেলা, যেখানে মাদক বাণিজ্য ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান প্রায়শই ঘটে, সেখানে ক্রসফায়ারের সংখ্যা সর্বাধিক। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই ঘটনাগুলোকে নজরদারিতে রাখছে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই উদ্বেগ এতটাই তীব্র হয়েছে যে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ র‍্যাবের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই পদক্ষেপের পরে ক্রসফায়ারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ২০২২ সালে মাত্র ৪ জন এবং ২০২৩ সালে ১ জন ক্রসফায়ারে নিহত হন, যা আগের বছরের পরিসংখ্যানের তুলনায় অনেক কম।

যেকোনো বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় ভুক্তভোগীর পরিবারগুলোর জন্য তা এক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা। তাদের জন্য এ একটি অনিশ্চিত জীবন, যেখানে ভয়, হুমকি এবং নিরাপত্তাহীনতা লেগেই থাকে। অনেক পরিবার ঘটনার প্রতিবাদ বা মামলা করার সাহস পায় না। যারা সাহস করে মামলা করতে চায়, তাদেরও হুমকির মুখে পড়তে হয়। কেউ কেউ হয়রানির সম্মুখীন হন, এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপের ফলে বিচারপ্রাপ্তি অসম্ভব হয়ে ওঠে।

কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিরা আদৌ কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না; তবু রাজনৈতিক প্রভাব ও ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে তাদের ক্রসফায়ারের শিকার হতে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন ঘটনা নিয়ে প্রায়শই সাজানো বক্তব্য তৈরি করে, যেখানে নিহতদের সন্ত্রাসী, ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী বা সশস্ত্র হামলাকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়। মানবাধিকার সংস্থা আসকের মতে, এই প্রথা একটি অস্থিরতা ও ভয়ভীতির সংস্কৃতি তৈরি করছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই ক্রসফায়ারের প্রবণতা আরো বাড়তে থাকে, এবং বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ক্রসফায়ারের ঘটনা অধিক মাত্রায় ঘটে। আসকের মতে, গত ১৫ বছরে বিএনপির ৬৫১ জন এবং জামায়াতে ইসলামীর ৫০ জনের বেশি নেতা–কর্মী ক্রসফায়ারের নামে হত্যার শিকার হয়েছেন।

২০১৮ সালের নির্বাচনকালে ক্রসফায়ারের ঘটনা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। এই সময়কালে একটি বিশেষ অভিযান চালানো হয়, যা ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ নামে পরিচিতি পায়। যদিও এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল মাদক কারবারিদের নির্মূল করা, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযানের শিকার হয়েছেন রাজনৈতিক কর্মীরা, যা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও প্রশ্ন ওঠে।

পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময়ে ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলোকে আত্মরক্ষার প্রয়াস বলে দাবি করেছেন। তাদের মতে, অভিযুক্তরা পুলিশের উপর আক্রমণ করতে গেলে তারা পাল্টা গুলি চালাতে বাধ্য হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর বলেন, “বিচারবহির্ভূত হত্যার সুযোগ নেই, আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীর প্রচলিত আইনে বিচার হোক।” তবে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ক্রসফায়ারকে অপরাধ দমনের একটি সহজ পথ হিসেবে দেখেন এবং এই ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রে তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।

র‍্যাবের পক্ষ থেকেও দাবি করা হয় যে ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন বা নির্দেশনা মেনে তারা কাজ করেন। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে বিশেষভাবে আলোচিত ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়।

একাধিক কর্মকর্তার মতে, জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে র‍্যাব ও পুলিশ প্রায়শই ক্রসফায়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সাধারণ মানুষ এই ঘটনাগুলোকে অপরাধ দমনের একমুখী প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বারবার ক্রসফায়ারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা এটিকে মানবাধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে এ বিষয়ে প্রচার চালিয়েছে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ক্রসফায়ারের ঘটনায় র‍্যাব ও এর কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর ফলে ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমে আসে এবং সাময়িকভাবে হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনার ব্যাপারে সংযম দেখায়।

আন্তর্জাতিক মহলের এই পদক্ষেপ দেশীয় রাজনীতিতেও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারের তরফ থেকে বিষয়টি স্বীকার না করলেও ক্রসফায়ারের ঘটনার সংখ্যা কমে আসা লক্ষণীয়। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয় এবং সরকারের প্রয়োজন আরও সুসংহত নীতিমালা প্রণয়ন করা যাতে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা পুরোপুরি বন্ধ হয়।

ক্রসফায়ারের ব্যাপকতা বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরেও প্রভাব ফেলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে যে, অপরাধ দমনের জন্য ক্রসফায়ার একটি কার্যকর পদ্ধতি। রাজনীতিবিদদের ও মিডিয়ার একাংশ এটিকে সন্ত্রাস ও অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় হিসেবে তুলে ধরে। ফলে অপরাধী বা সন্দেহভাজনদের ক্ষেত্রে জনগণের একাংশের সহানুভূতি তৈরি হয় না। তবে এভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে যুক্তিযুক্ত হিসেবে তুলে ধরায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অনেক সময় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।

বর্তমান সরকার কর্তৃক গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন বলেন, “মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের সংস্কারের কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এমন কিছু সংস্কার প্রস্তাব দিতে চাই, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।”

তিনি আরও জানান, কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও আচরণে পরিবর্তন আনতে কাজ করছে এবং সংবিধান ও মানবাধিকারের ওপর ভিত্তি করে নতুন মানদণ্ড তৈরি করতে চায়।

এই বিভাগের আরও পড়ুন