রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদটপ নিউজসংবিধান লঙ্ঘন: বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা

সংবিধান লঙ্ঘন: বিদেশি নাগরিকত্ব নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত বর্তমান ও সাবেক মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্যদের দ্বৈত নাগরিকত্ব এবং বিদেশে সম্পদ অর্জনের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যারা অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন বা সেই দেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন, তারা বাংলাদেশের মন্ত্রী বা সংসদ সদস্য হতে পারবেন না।

অথচ, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে, পূর্ববর্তী সরকারগুলোর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থাকা ২৪ জন ব্যক্তির বিদেশি নাগরিকত্ব অথবা গ্রিন কার্ড রয়েছে।

গত ৫ আগস্ট সংঘটিত ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি বিশাল অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করেছে। এই অনুসন্ধানের মূল লক্ষ্য হলো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের দ্বারা অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদের তথ্য উন্মোচন করা এবং বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনাগুলো তদন্ত করা। ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলমান এই অনুসন্ধানে ১৮০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম প্রকাশ পেয়েছে। এদের মধ্যে ২৪ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব অথবা বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি (স্থায়ী রেসিডেন্স কার্ড) থাকার তথ্য দুদক নিশ্চিত করেছে।

সাইপ্রাসে নাগরিকত্ব, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব পেয়েছেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামের স্থায়ী রেসিডেন্স কার্ড নিয়েছেন এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যুক্তরাজ্যের নাগরিক। এ ছাড়া সাবেক দুই প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও জুনাইদ আহ্‌মেদের যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ গ্রিন কার্ড রয়েছে। এই নেতারা বিদেশি নাগরিকত্ব বা স্থায়ী রেসিডেন্স কার্ড গ্রহণ করলেও দেশের জনগণকে তা জানাননি, যা বাংলাদেশের সংবিধানের পরিপন্থী।

সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন এ প্রসঙ্গে বলেন, “বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া বা মন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান না। যদি কেউ তথ্য গোপন করে এ ধরনের পদে আসীন হন, তবে তা আইন ও সংবিধান পরিপন্থী।”

প্রাক্তন পাঁচজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তাঁদের মধ্যে আ হ ম মুস্তফা কামাল, মো. তাজুল ইসলাম, সাইফুজ্জামান চৌধুরী, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এবং মো. মাহবুব আলী রয়েছেন। বিশেষ করে মাহবুব আলীকে গত ১৫ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অন্যান্য দেশেও স্থায়ী অধিবাস

যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ড বা নাগরিকত্বধারী সাতজনের মধ্যে সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান রয়েছেন, যাঁরা বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। কানাডার নাগরিক হিসেবে আবদুর রহমান, মাহবুব উল আলম হানিফ, শামীম ওসমানসহ আরও কয়েকজনের নামও দুদকের অনুসন্ধানে এসেছে।

বিদেশে সম্পদের খোঁজ

দুদক বলছে, এসব ব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই বিদেশে বাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদ রয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আমিরাতে বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৪৮ কোটি ডলার। আর সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের লন্ডনে বাড়ি রয়েছে এবং সেখানে তাঁর মেয়ে বসবাস করেন। আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শামীম ওসমানের কানাডার টরন্টো শহরে বাড়ি রয়েছে, এছাড়া দুবাইয়ে তাঁর আরেকটি বাড়িও রয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সহকারী আবদুস সোবহানও যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কিছু সম্পত্তির মালিক, যা গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ ডলারের বেশি, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৪২ কোটি টাকা।

দুদকের মহাপরিচালক আক্তার হোসেন বলেছেন, “যাঁরা বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন এবং দেশে মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।” দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, “মন্ত্রী-সংসদ সদস্য হিসেবে তাঁদের শপথ গ্রহণই ছিল অবৈধ।”

দুদকের অনুসন্ধানে এও উঠে এসেছে যে, এসব নেতারা শুধু বিদেশি নাগরিকত্বই গ্রহণ করেননি, বরং বিদেশে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছেন এবং বৈদেশিক মুদ্রার মাধ্যমে অর্থ পাচারের সাথেও জড়িত।

প্রভাবশালী এ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিও জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।

তিনি বলেন, বিদেশি নাগরিকত্বধারী এসব নেতাদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের প্রভাব থেকে সরে আসা বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৬ অনুযায়ী, দ্বৈত নাগরিকত্বধারী ব্যক্তিদের সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা নেই, তবে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নিয়ম-নীতির বাইরে গিয়ে ক্ষমতায় থেকেছেন। তাঁরা শুধু সংবিধান লঙ্ঘন করেননি, বরং জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন এবং বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে দেশীয় অর্থনীতির ক্ষতি করেছেন।

এই বিভাগের আরও পড়ুন