জনগণের আস্থা অর্জন ও পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের পুলিশ বাহিনীতে পরিবর্তনের যাত্রা শুরু হয়েছে। সাড়ে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে পুলিশের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বদলি, পদোন্নতি, আর্থিক লেনদেন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে বাহিনীটি। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন উদ্যোগে গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন জনবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক একটি পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমান সংস্কার কার্যক্রমের উদ্দেশ্য শুধু বাহিনীর কাঠামোগত পরিবর্তন নয়; বরং এটি একটি বৃহত্তর জনসম্পৃক্ত ও কার্যকর বাহিনী গঠন করা। জনস্বার্থে পুলিশি কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং বাহিনীর জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করা হচ্ছে।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন জানিয়েছেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য হলো একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা, যেখানে পুলিশের কর্মকাণ্ড জনগণের মঙ্গল এবং সেবার জন্য নিবেদিত থাকবে। পুলিশ বাহিনী যেমন তাদের নিজস্ব চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যা নিয়ে কথা বলছে, তেমনি আমরা জনগণের মতামতও সংগ্রহ করছি, যাদের পুলিশিং কার্যক্রম সরাসরি প্রভাবিত করে।”
সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটপ্রধান এবং অন্যান্য পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব বৈঠকে পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তারা জানিয়েছে, বর্তমানে বাহিনীতে যানবাহনের সংকট রয়েছে। প্রয়োজনীয় যানবাহন সংখ্যা ১৬ হাজার ১২৪টি হলেও বাহিনীতে বর্তমানে আছে ১০ হাজার ৯৪৬টি, যা পুলিশের কার্যক্রমে সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
এছাড়া পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার অভাবে বাহিনীটির কার্যক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। আধুনিক অপরাধ মোকাবিলায় প্রযুক্তিনির্ভর প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এই বৈঠকে উঠে এসেছে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে পুলিশ সদস্যদের আরও উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হলে তাদের দক্ষতা বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, ১৮৬১ সালের পুরনো পুলিশ আইন এবং পুলিশের রেগুলেশন অব বেঙ্গল আইনের বিভিন্ন ধারা বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ঔপনিবেশিক যুগে তৈরি এসব আইন এককভাবে শাসনের মনোভাব বহন করে, যা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কার্যকর নয়। এই আইনে পুলিশকে একটি নির্বাহী বিভাগের অধীনে রেখে দ্বৈত শাসনের প্রথা তৈরি করা হয়েছে, যা পুলিশের স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতা বাধাগ্রস্ত করে।
সংস্কারের অংশ হিসেবে কমিশন জনসম্পৃক্ত পুলিশিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন উন্নত দেশের মডেল অনুসরণ করার পরিকল্পনা করছে। ইংল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতের মতো দেশে মেট্রোপলিটন পুলিশ ভলান্টিয়ার, ন্যাশনাল পুলিশ ক্যাডেট কোরসহ ভলান্টিয়ার পুলিশিং ব্যবস্থার প্রমাণ রয়েছে।
বিশেষ করে ভারতীয় স্টুডেন্ট পুলিশ ক্যাডেট প্রকল্পের মডেলটি ব্যবহার করে দেশের শিক্ষার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব উঠে এসেছে। এতে পুলিশে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পাবে এবং শিক্ষার্থীরা সামাজিক কাজে অবদান রাখতে সক্ষম হবে। এর মাধ্যমে জনমুখী পুলিশিং ব্যবস্থার একটি নতুন দিক উন্মোচিত হবে।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, “পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্ব বৃদ্ধির জন্য নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা জরুরি। এছাড়া পুলিশের বেআইনি ও অপেশাদার কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন গঠন করে তদন্তের উৎকর্ষতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
বর্তমানে পুলিশ সদস্যদের কার্যক্রমের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ইউনিটের পাশাপাশি বাহ্যিক তদন্ত ইউনিট গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া পুলিশে অপেশাদার এবং বেআইনি কর্মকাণ্ডের জন্য নিরপেক্ষ তদন্তের ব্যবস্থা নেওয়া হলে বাহিনীর পেশাদারিত্বের মান উন্নত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে ইতিমধ্যেই জনমতের ভিত্তিতে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘কেমন পুলিশ চাই’ শিরোনামে জনগণের মতামত নেওয়া হচ্ছে। ১৭টি প্রস্তাবের মধ্যে জনবান্ধব, জবাবদিহিমূলক, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং দুর্নীতিমুক্ত পুলিশের ধারণাগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এছাড়া মানবাধিকার রক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নিরপেক্ষ এবং আইনের শাসনে আনুগত্যের বিষয়ে পুলিশের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। জনমত জরিপে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে আছে, বিদ্যমান পুলিশ আইন যুগোপযোগী করা এবং থানাগুলোতে জনগণের অভিযোগের দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য একটি অভিযোগ কমিশন গঠন।
অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এই সংস্কার প্রক্রিয়াকে টেকসই এবং জনসমর্থিত করার লক্ষ্যে কয়েকটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। একাধিক সূত্র জানায়, সংস্কার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পুলিশ সদস্যদের কাজের পরিবেশ এবং সুযোগ-সুবিধা উন্নত করা জরুরি। এছাড়া পুলিশ সদস্যদের বেতন, ঝুঁকি ভাতা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো কল্যাণমূলক কার্যক্রমে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা জানান, “বিশ্বমানের পুলিশ বাহিনী গড়তে হলে শুধু বাহিনীর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাই নয়, বরং জনসম্পৃক্ত একটি সেবামূলক বাহিনী নিশ্চিত করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর জোর দিতে হবে।”