জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, স্মার্ট এনআইডি কার্ড প্রিন্টসহ জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত সেবার নামে কোটি কোটি টাকার ঘুষ লেনদেনের একটি বিশাল চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ চক্রে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় ও জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং বহিরাগত দালাল জড়িত।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এই চক্র ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে ঘুষ লেনদেন করেছে। এমনকি নগদ লেনদেনের তথ্যও অনেক ক্ষেত্রে অজানা রয়ে গেছে। একজন এনআইডি সংশোধন করতে গড়ে ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার ঘটনা উঠে এসেছে।
চক্রের এক কর্মচারী, যিনি মাসে মাত্র ১৯ হাজার টাকা বেতন পান, তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং বিকাশে ৩৬ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তার মাধ্যমেই এ চক্রের অন্তত ১১ জন সদস্য টাকা ভাগাভাগি করেছেন। এ কর্মচারী আরও চারজনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন এবং নিজেই এনআইডি সংশোধনের কাজ সমন্বয় করেছেন।
অন্যদিকে, আরেক কর্মচারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৪৮ লাখ ২১ হাজার টাকা, আরেকজনের ১৫ লাখ ৬৬ হাজার এবং তৃতীয়জনের অ্যাকাউন্টে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার টাকার লেনদেন হয়েছে। এমন আরও অনেক কর্মচারীর বড় অঙ্কের লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
কীভাবে পরিচালিত হয় চক্রের কার্যক্রম?
এনআইডি সংশোধনের জন্য ইসির কর্মকর্তারা দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে কাজ করতেন। রাজধানীর বিভিন্ন কম্পিউটার দোকান থেকে এই চুক্তি করা হতো। সংশোধনের কাজ ঢাকায় কর্মরত কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দ্রুত অনুমোদিত হতো। এরপর হাতেহাতে টাকা ভাগ করা হতো অথবা ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন করা হতো।
এনআইডি সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রায় ২০০-৩০০ জনের কাজ চক্রটি সম্পন্ন করেছে। এতে অসাধু কর্মচারীরা নিজেদের আত্মীয়স্বজনের নাম ব্যবহার করে অথবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশ দেখিয়ে কাজ দ্রুত করিয়েছেন। এসব কাজের মাধ্যমে তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করেছেন, যা তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, আইডিইএ প্রকল্পের ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. বুলবুল আহমেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সবচেয়ে বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। তার অ্যাকাউন্টে গত দুই বছরে বেতন ছাড়া ১ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং বিকাশে ৩৬ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। তিনি সরাসরি ২০০-৩০০ এনআইডি সংশোধনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার মাধ্যমে অন্তত ১১ জন কর্মচারী টাকা পেয়েছেন।
আরেক ডেটা এন্ট্রি অপারেটর মো. মাহাবুবুর রহমানের ব্যাংক এবং বিকাশে অর্ধকোটি টাকার লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে। তার অ্যাকাউন্টে ৩৮ লাখ টাকা ব্যাংক লেনদেন এবং ১২ লাখ টাকা বিকাশ লেনদেন হয়েছে। তিনিও একইভাবে ২০০-৩০০ এনআইডি সংশোধনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এই চক্রে নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীরও সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. আতাউল হক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মাসদু আলমসহ কয়েকজনের নাম উঠে এসেছে। তবে তাদের সম্পৃক্ততার বিস্তারিত তথ্য এখনও জানা যায়নি।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিম বলেন, “এনআইডি সেবার নামে ঘুষ লেনদেন এবং জালিয়াতির মতো কর্মকাণ্ড আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এই সিন্ডিকেটের কার্যক্রম তদন্ত করা হচ্ছে এবং এর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন, “এনআইডি সেবা সহজীকরণের জন্য আমরা দিনরাত কাজ করছি। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি সুনাম নষ্ট করছে।”