প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স শহর। সময়টা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী। এথেন্স তখন জ্ঞান, সংস্কৃতি ও দর্শনের এক অপরূপ মিলনস্থল। এই শহরেই জন্ম নিয়েছিলেন এক মহাপুরুষ, যাঁর নাম সক্রেটিস। তিনি ছিলেন এমন এক দার্শনিক, যিনি নিজের কোনো লিখিত রচনা রেখে যাননি, তবুও তাঁর চিন্তাধারা ও দর্শন পরবর্তী দুই সহস্রাব্দ ধরে পশ্চিমা সভ্যতাকে প্রভাবিত করে আসছে।
সক্রেটিসের শৈশব সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। তাঁর বাবা সফ্রোনিসকাস ছিলেন একজন স্থপতি বা ভাস্কর, আর মা ফায়েনারেত ছিলেন ধাত্রী। এথেন্সের অ্যালোপেস অঞ্চলে তাঁর শৈশব কাটে। তখনকার এথেন্সে ১৮ বছর বয়স হলে তরুণদের রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে হতো, যোগ দিতে হতো মিলিটারি সার্ভিসে। সক্রেটিসও এ নিয়ম মেনে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সরল, বিনয়ী ও জিজ্ঞাসু মনোভাবের অধিকারী।
সক্রেটিসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর প্রশ্ন করার ক্ষমতা। তিনি কোনো প্রচলিত বিশ্বাস বা ধারণাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতেন না। সবকিছুর গভীরে প্রবেশ করে সত্যকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতেন। তাঁর মতে, জ্ঞান হচ্ছে জিজ্ঞাসা ও অন্বেষণ। তিনি বলতেন, “আমি জানি যে আমি কিছুই জানি না।” এই স্বীকারোক্তি তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল। তিনি মানুষের আত্মার উন্নয়নের জন্য জ্ঞানচর্চাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন।
এথেন্সের রাস্তাঘাট, হাটবাজারে তিনি আবালবৃদ্ধবনিতার সঙ্গে দর্শনচর্চা করতেন। কোনো নির্দিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তিনি গড়ে তোলেননি। তাঁর এই মুক্ত চিন্তাধারা ও তরুণদের মধ্যে সত্যের অনুসন্ধান জাগিয়ে তোলা তখনকার শাসকগোষ্ঠী ও এলিট সোসাইটির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় যুবসমাজকে বিপথে নেওয়ার অভিযোগে।
৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, ৭০ বছর বয়সে, সক্রেটিসের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। অভিযোগ ছিল, তিনি ধর্মদ্রোহিতা করছেন এবং তরুণদের মন বিষিয়ে দিচ্ছেন। ৫০১ জন বিচারকের সামনে তাঁর বিচার হয়। বিচারকরা তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করেন মাত্র ৬০ ভোটের ব্যবধানে। তাঁকে হেমলক বিষ পান করে মৃত্যুদণ্ড মেনে নিতে বলা হয়। তাঁর শিষ্যরা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেও তিনি ন্যায় ও সত্যের প্রতি অটল থেকে মৃত্যুবরণ করেন।
সক্রেটিসের এই করুণ পরিণতি আমাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। তিনি নিজের জীবনের চেয়ে সত্য ও ন্যায়কে অধিক মূল্য দিয়েছিলেন। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, “অপরীক্ষিত জীবনের কোনো মূল্য নেই।” তাঁর এই আত্মত্যাগ তাঁকে ইতিহাসে অমর করে তুলেছে।
সক্রেটিসের জীবনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী দিক হলো তাঁর শেষ দিনগুলো। কারাগারে বসে তিনি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। তাঁর স্ত্রী জানথিপি ও তিন পুত্র ছিলেন দারিদ্র্যের মধ্যে। স্ত্রী জানথিপির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। বলা হয়, জানথিপি ছিলেন রাগী স্বভাবের। তবুও স্বামীর মৃত্যুর সময় তাঁর শোকাবহ চিত্র আমাদের মনকে আন্দোলিত করে।
সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, কেউ জেনেবুঝে পাপ করতে পারে না। অজ্ঞতা থেকেই সব পাপের জন্ম। তাঁর এই বিশ্বাস আমাদের ভাবিয়ে তোলে। সত্যিকার জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে এবং সমাজকে পরিবর্তন করতে পারে—এই ছিল তাঁর দর্শন।
তাঁর শিষ্য প্লেটো ও জেনোফেন তাঁর জীবন ও দর্শনকে লিপিবদ্ধ করেছেন। প্লেটোর ডায়ালগগুলোতে সক্রেটিস প্রধান চরিত্র। প্লেটোর মাধ্যমেই আমরা সক্রেটিসের চিন্তাধারা সম্পর্কে জানতে পারি। তবে প্লেটোর লেখায় সক্রেটিসের প্রতি কতটা বিশ্বস্ততা আছে, তা নিয়ে গবেষকরা এখনও বিতর্ক করেন।
সক্রেটিসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো ছিল, তা আসলে সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থানের ফলাফল। তিনি দেবতা ও ধর্ম সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, ঈশ্বর হলেন যুক্তির প্রতিরূপ। তাই মূর্তি বা প্রতিমা পূজার বিরোধিতা করেছিলেন। এ জন্যই শাসকগোষ্ঠী ও রক্ষণশীল সমাজ তাঁকে বিপজ্জনক ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করেছিল।
মৃত্যুর পরেও সক্রেটিসের প্রভাব কমেনি। বরং তাঁর আত্মত্যাগ ও চিন্তাধারা আরও বিস্তৃত হয়েছে। ২০১৭ সালে, তাঁর মৃত্যুর প্রায় আড়াই হাজার বছর পর, গ্রিসের আদালতে পুনরায় তাঁর বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। এটি প্রমাণ করে যে, সত্য ও ন্যায়ের জন্য তাঁর সংগ্রাম আজও আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক।
সক্রেটিসের বিখ্যাত উক্তি, “সত্যিকারের জ্ঞানী হওয়ার প্রক্রিয়া তখনই শুরু হয়, যখন আপনি জানবেন যে আপনি কিছুই জানেন না,” আমাদের আত্মসমালোচনার দিকে নিয়ে যায়। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন, আত্মার উন্নয়ন না করে শারীরিক সুস্থতা অর্থহীন। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন সাধনই মানুষের প্রথম ও প্রধান কাজ।
তাঁর মৃত্যুর কাহিনি আমাদের চোখে পানি আনে। হেমলক বিষ পান করার আগে তিনি শান্ত ও দৃঢ় ছিলেন। মৃত্যুকে তিনি ভয় পাননি। তাঁর মতে, মৃত্যু হয়তো চিরস্থায়ী ঘুম অথবা নতুন জীবনের শুরু। যাই হোক না কেন, তিনি সত্যের পথে অটল ছিলেন।
সক্রেটিস আমাদের দেখিয়েছেন, কেমন করে একজন মানুষ নিজের আদর্শের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। তাঁর জীবন ও মৃত্যু আমাদের জন্য এক অনন্ত প্রেরণার উৎস। তিনি ছিলেন এক মহানায়ক, যাঁর চিন্তাধারা ও আত্মত্যাগ মানবসভ্যতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সক্রেটিসের জীবনকে ঘিরে রয়েছে অনেক রহস্য ও কাহিনি। তাঁর শিষ্যরা তাঁকে নিয়ে যে বিবরণ দিয়েছেন, তা থেকে আমরা তাঁর চরিত্রের নানা দিক সম্পর্কে ধারণা পাই। তিনি ছিলেন এক নিরহঙ্কারী ও সরল মানুষ। তিনি নিজেকে অন্যদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে ভালোবাসতেন। তাঁর কথায়, “নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াই আমার অভ্যাস।”
সক্রেটিসের দারিদ্র্য ও সংসারজীবনও উল্লেখযোগ্য। তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো পেশা গ্রহণ করেননি। দর্শনচর্চাই ছিল তাঁর জীবনের মূল উদ্দেশ্য। এ জন্য পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্ব পালনে অবহেলা ছিল। তাঁর স্ত্রী জানথিপি এ কারণে তাঁকে অবজ্ঞা করতেন। তবে স্বামীর প্রতি তাঁর ভালোবাসাও কম ছিল না। সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় জানথিপির শোকাবহ চিত্র তা প্রমাণ করে।
তিনি বিশ্বাস করতেন, “জ্ঞানই পুণ্য।” তাঁর মতে, ভালোকে জানা মানেই ভালো কাজ করা। মানুষ খারাপ কাজ করে শুধুমাত্র অজ্ঞতার কারণে। পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটি ভালো আছে, তা হলো জ্ঞান; আর একটি খারাপ আছে, তা হলো অজ্ঞতা। এই বিশ্বাস তাঁকে মানবজাতির সত্যিকার কল্যাণের পথে নিয়ে গিয়েছিল।
সক্রেটিসের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড ছিল তৎকালীন এথেন্সের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের ফলাফল। তিনি গণতন্ত্রের সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তিনি দেখেছিলেন, গণতন্ত্রের আড়ালে অনেক অন্যায় ও অবিচার হচ্ছে। তিনি সত্য ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, যা শাসকগোষ্ঠীর জন্য হুমকি ছিল।
বিচারের সময় তিনি বলেন, “আমি এথেন্সের ছোট-বড় সবাইকে বলি, তোমরা তোমাদের শরীর বা অর্থের পেছনে ছুটো না। তোমাদের প্রথম কর্তব্য হওয়া উচিত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে আত্মার উন্নয়ন সাধন।” তাঁর এই বক্তব্য আজও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। আমরা আজও জ্ঞানচর্চার চেয়ে ভৌত সম্পদের পেছনে ছুটছি।
সক্রেটিসের মৃত্যুর সময় তাঁর শেষ কথাগুলো ছিল, “ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াস আমাদের কাছে একটি মোরগ পায়, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভুলো না যেন।” এই রহস্যময় উক্তি অনেক ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, তিনি বলতে চেয়েছিলেন, মৃত্যুই আসল আরোগ্য, যা দেহ থেকে আত্মার মুক্তি দেয়।
তাঁর শিষ্য প্লেটো ও জেনোফেন সক্রেটিসের জীবনের নানা ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন। তবে তাঁদের বর্ণনায় কিছু পার্থক্য রয়েছে। প্লেটো তাঁর গ্রন্থগুলোতে সক্রেটিসকে প্রধান চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। জেনোফেনের বর্ণনায় আমরা সক্রেটিসের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে জানতে পারি।
সক্রেটিসের দর্শন পরবর্তী দার্শনিকদের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাঁর শিষ্য প্লেটো, এবং প্লেটোর শিষ্য অ্যারিস্টটল, তাঁদের দর্শনের মাধ্যমে পশ্চিমা দর্শনের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। সক্রেটিসের জ্ঞানচর্চার পদ্ধতি, যা সক্রেটিক মেথড নামে পরিচিত, আজও শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে।
সক্রেটিসের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস। তিনি দেবতাদের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, কিন্তু প্রচলিত ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে সন্দিহান ছিলেন। তিনি যুক্তি ও নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন। এ জন্যই তাঁকে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।
তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো আনা হয়েছিল, তা আসলে মুক্ত চিন্তাধারা ও সত্যের অনুসন্ধানকে দমন করার প্রয়াস ছিল। তিনি তরুণদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। শাসকগোষ্ঠী এটাকে নিজেদের ক্ষমতার জন্য হুমকি মনে করেছিল।
সক্রেটিস আমাদের শিখিয়েছেন, কিভাবে নিজের বিশ্বাস ও নীতির জন্য দৃঢ় থাকতে হয়। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য শিক্ষা। তিনি বলেছিলেন, “নিজেকে জানো।” এই সহজ বাক্যটির গভীর তাৎপর্য রয়েছে। আত্মজ্ঞানই মানুষের সত্যিকার মুক্তির পথ।
আজকের সমাজে আমরা যদি সক্রেটিসের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, তাহলে আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। সত্য, ন্যায়, জ্ঞান ও নৈতিকতার পথে আমরা যদি এগিয়ে যাই, তাহলে মানবজাতির কল্যাণ নিশ্চিত হবে।
সক্রেটিসের জীবন ও মৃত্যু আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যের পথে চলা সবসময় সহজ নয়। কিন্তু ন্যায়ের জন্য, আদর্শের জন্য, আমরা যদি ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকি, তাহলে আমাদের জীবন হবে অর্থবহ। তাঁর মতো মহাপুরুষদের আদর্শ আমাদের আলোকিত করে।
সক্রেটিসের এই করুণ অধ্যায় ইতিহাসে একটি মর্মান্তিক ঘটনা হলেও, তাঁর জীবন ও দর্শন আমাদের জন্য এক অমূল্য সম্পদ। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, জ্ঞান ও নৈতিকতার পথে চলা মানুষ কখনো পরাজিত হয় না। তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় চির অম্লান হয়ে থাকবে।