থাইল্যান্ডে হঠাৎ বেড়েছে বাংলাদেশিদের সংখ্যা। প্রতিদিন লাখের হাজারের মতো মানুষ দেশটিতে শুধুমাত্র পর্যটন নয়, চিকিৎসা সেবার জন্যও আসছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার কূটনৈতিক উত্তেজনার কারণে মানুষ এখন ব্যাংকককে বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছেন। এ পরিস্থিতিতে থাইল্যান্ডে সক্রিয় বাংলাদেশি দালাল চক্র অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য কৌশলগতভাবে কাজ করছে। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতেও বাংলাদেশিদের যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আঞ্চলিক রাজনীতির ধাক্কা পড়েছে অর্থনীতিতেও। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অজুহাত দিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশিদের পর্যটন ভিসা নিষেধ করছে। গুরুতর রোগী ছাড়া অন্যদের মেডিকেল ভিসা দেয় না। এছাড়া, ভারতের অনেক প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসক ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা থেকে আগতদের চিকিৎসা না দেওয়ার। এর ফলে বাংলাদেশিদের কাছে থাইল্যান্ডের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেছে। থাকার খরচ দিল্লির তুলনায় কম হওয়ার কারণে ব্যাংকক যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে দেশের স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জানান, ভারতের ভিসা বন্ধের পরিস্থিতিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো যেতে পারে। রোগীদের কেন বিদেশে যেতে হচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা করে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার মান উন্নত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলিও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উন্নত সেবা প্রদান করতে পারে।
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ লাখ রোগী ভারত যান এবং তাদের চিকিৎসায় প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়। ভারতের ভিসা বন্ধের কারণে এখন প্রশ্ন উঠছে, লাখ লাখ বাংলাদেশি কী হবে? থাইল্যান্ড হয়ে উঠছে চিকিৎসা, পর্যটনসহ বিভিন্ন কাজে ভারতের বিকল্প বাজার।
চিকিৎসার জন্য বেশিরভাগ বাংলাদেশি ব্যাংককের সুকুমভিত এলাকার বিভিন্ন হোটেলে থাকেন। এখানে বামরুনগ্রাদসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে যা উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করে। বাংলা খাবারের হোটেল যেমন ‘মনিকাস কিচেন’ ও ‘স্টার রেস্তোরাঁ’ রয়েছে, যেখানে হালাল খাবার পরিবেশন করা হয়। থাইল্যান্ডে ভারতের তুলনায় ২০-২৫% কম খরচে উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যায়। ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ফয়েজ আহমেদ এক বছর ধরে মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভুগছিলেন। ভারতের ভিসা না পেয়ে থাইল্যান্ডে চিকিৎসা করিয়েছেন ফয়েজ, যিনি বলেন থাইল্যান্ডের সেবা মান ভারতে তুলনায় অনেক ভালো।
থাইল্যান্ডেও অনেক রোগী দালালদের খাপ্পরে পড়ে ভুক্তভোগী হচ্ছেন। ভুক্তভোগী আব্দুর রহমান বলেন, থাই ভাষা না জানায় দালালরা রোগীদের প্রতারণা করছে। চিকিৎসার খরচ ভারতীয় হাসপাতালের তুলনায় কম হলেও, দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত অর্থ চাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। রোগীদের জন্য নিরাপদ চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশি দূতাবাসকে আরও সক্রিয় হতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।
থাইল্যান্ডের পাশাপাশি সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতেও বাংলাদেশিদের যাতায়াত বৃদ্ধি পেয়েছে। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া উচ্চমানের চিকিৎসা সেবা প্রদান করে যা অনেক বাংলাদেশির আকর্ষণীয় গন্তব্য। মালয়েশিয়া হাইকমিশন জানিয়েছে, তাদের চিকিৎসা খরচ থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের তুলনায় ৭০% কম। তবে, ভারতের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও, মালয়েশিয়ায় চিকিৎসকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা রয়েছে, যা রোগীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।
১ ডিসেম্বর থেকে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশিদের জন্য ই-ভিসা চালু হয়েছে। এর ফলে ভিসা পেতে সহজ হয়েছে এবং থাইল্যান্ডের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা থেকে ব্যাংককে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করছে থাই এয়ারওয়েজ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বিমান। চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালু হলে যাত্রী আকর্ষণ আরও বেড়ে যাবে বলে ট্রাভেল এজেন্টরা আশা প্রকাশ করেছেন।
থাইল্যান্ডের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর থাইল্যান্ডে প্রায় ২.৮ কোটি বিদেশি পর্যটক এসেছেন, যার মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। চলতি বছর থাইল্যান্ড ৩৬ লাখ ৭০ হাজার পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য স্থির করেছে এবং জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সাড়ে ১৭ লাখ পর্যটক আগমন করেছে, যার রাজস্ব হয়েছে সাড়ে ২২ বিলিয়ন ডলার।
থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া হয়ে উঠছে বাংলাদেশের চিকিৎসা ও পর্যটনের নতুন কেন্দ্রবিন্দু। কূটনৈতিক উত্তেজনা এবং ভিসা সমস্যার কারণে বাংলাদেশিদের কাছে ভারত ছেড়ে এই দেশগুলো আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে উদিত হচ্ছে। তবে, দালাল চক্রের প্রতারণা ও ভাষাগত সমস্যার মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতকে উন্নত করে বিদেশনির্ভরতা কমিয়ে আনা এবং নিরাপদ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হিসেবে রয়ে গেছে।