করোনা মহামারী, বৈশ্বিক মন্দা এবং ডলার সংকট- এই ত্রিমুখী সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশের অর্থনীতি। এই দুঃসময়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষ যখন জীবনযাত্রার ন্যূনতম মান ধরে রাখার জন্য সংগ্রাম করছে, ঠিক তখনই বিদেশে পুঁজি পাচারের প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে এই ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, গত এক বছরে বিদেশে পুঁজি সরানোর পরিমাণ ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বৈধভাবে প্রায় ২ কোটি ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৪০ কোটি টাকা) বিদেশে সরানো হয়েছে, যা গত ৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত ১৫ বছরে দেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। অর্থাৎ, দীর্ঘ সময় ধরে এই অনৈতিক কার্যকলাপ চলছে এবং এর ফলে দেশের অর্থনীতি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বৈধ পথে সরানো অর্থের চেয়ে অবৈধ পথে পাচারের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি।
বিভিন্ন পদ্ধতিতে দেশ থেকে পুঁজি বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে: মিথ্যা ইনভয়েস: আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দেখিয়ে টাকা বিদেশে পাঠানো। অবৈধ হুন্ডি: বেআইনি ভাবে টাকা বিদেশে পাঠানো। বিদেশে সম্পদ ক্রয়: অবৈধ আয়ের টাকা দিয়ে বিদেশে বাড়ি, গাড়ি অথবা অন্যান্য সম্পদ ক্রয়।
সূত্র জানায়, বেক্সিমকো, এস আলম, নাসা গ্রুপসহ দেশের বেশ কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপ বিদেশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এবং অবৈধ পথে অর্থ পাচার করছেন। এছাড়াও, রাজনীতিবিদ, আমলা এবং অন্যান্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা ও এই অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত বলে অভিযোগ রয়েছে।
পুঁজি পাচার দেশের অর্থনীতিতে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যায়, টাকার মান পড়ে যায়, বিনিয়োগ হ্রাস পায়, কর আদায় কমে যায় ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়।
পুঁজি পাচার রোধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এর মধ্যে রয়েছে: আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ: পুঁজি পাচার বিরোধী কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর ভাবে প্রয়োগ করা। আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি: ব্যাংকিং এবং আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা। দুর্নীতি দমন: দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সক্রিয় করা এবং দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: পুঁজি পাচার রোধে অন্যান্য দেশের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পুঁজি পাচার একটি উদ্বেগজনক বিষয়। এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। অন্যথায়, দেশের অর্থনীতি আরও খারাপ অবস্থায় চলে যাবে।