বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের মানুষরা যুগের পর যুগ ধরে নিজেদের বাসস্থান নির্মাণে একটি বিশেষ স্থাপত্য রীতি অনুসরণ করে এসেছে, যা পরিচিত ‘মাচাং ঘর’ নামে। বন্যপ্রাণী এবং প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রভাব থেকে সুরক্ষা পেতে এই বিশেষ ধরনের ঘর নির্মাণের রীতি চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী, যেমন মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাকমা, ম্রো, এবং খুমীরা এই ঘর নির্মাণে দক্ষ হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটির ব্যবহার কমে এসেছে।
মাচাং ঘরের ধারণা প্রথম উদ্ভাবন হয়েছিল পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের আত্মরক্ষার প্রয়োজন থেকে। বন্যপ্রাণীর আক্রমণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিরাপদে থাকতে উঁচুতে বাসস্থান নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন পাহাড়িরা। ফলে একসময় তারা গাছ ও বাঁশের খুঁটি দিয়ে মাচাং ঘর তৈরি করতে শুরু করেন। ঘরগুলো সাধারণত মাটি থেকে প্রায় ৬-৭ ফুট উঁচুতে তৈরি করা হয়, যাতে নিচে পর্যাপ্ত জায়গা ফাঁকা থাকে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখার সুবিধা হয়।
মাচাং ঘরগুলো শুধু থাকার জায়গা নয়; এটি ছিল পরিবার এবং সমাজের লোকদের আড্ডার স্থান, উৎসব পালন এবং গল্প বলার জায়গা। বিশেষ করে শীতের দিনে এখানে বসে রোদ পোহানোর জন্য সবাই জমায়েত হতেন, নানা গল্প-কাহিনি শোনা হতো, আর দিনের পর দিন গল্প বলার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠত আত্মার বন্ধন। এই মাচাং ঘরের মঞ্চে বসে কেউ কাপড় শুকাতেন, কেউ বা নানা ধরনের ফসল, যেমন ধান, শাকসবজি ইত্যাদি সংরক্ষণ করতেন। পরিবারের প্রতিটি সদস্য মাচাং ঘরের কাজে ভূমিকা রাখত।
মাচাং ঘরের নির্মাণশৈলী বেশ সহজ অথচ মজবুত। গাছ ও বাঁশের মোটা খুঁটি মাটিতে পুঁতে তার ওপর কাঠের মাচা তৈরি করা হয়। তারপর মাচার ওপর খড়, কাঠ বা বাঁশের পাটাতন বিছিয়ে ছাউনি হিসেবে খড়, পাতা, বা বাঁশ দিয়ে ছাদ নির্মাণ করা হয়। মূল ঘরটিকে ঘিরে একটি খোলা জায়গা থাকে, যা কাপড় শুকানো বা শস্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়। পাহাড়ি এলাকায় গ্রীষ্মের প্রখর গরম এবং বর্ষার ভারী বৃষ্টিতে মাচাং ঘরের এই নির্মাণশৈলী উপকারী। উঁচুতে থাকায় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং বৃষ্টির পানি নিচে নেমে যায়।
পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির মধ্যে মাচাং ঘর এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বান্দরবানের মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খুমীসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠী মাচাং ঘরের ভিন্ন ভিন্ন রূপ তৈরি করে আসছেন। বিশেষ করে ম্রো ও খুমী সমাজের মানুষেরা মাচাং ঘরে কাপড় ও ধান শুকানো ছাড়াও সেখানে মাছ-মাংস প্রস্তুতের কাজও করেন। তাদের বিশ্বাস, মাচাং ঘরে রান্না করা খাবার প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত থাকে এবং এতে খাদ্যের স্বাদ বাড়ে।
চিমি ডলু পাড়ার ষাটোর্ধ্ব বাসিন্দা হ্লামেচিং মারমা জানান, “আমাদের শৈশবের সেরা মুহূর্তগুলো কাটত মাচাং ঘরে। দিনের বেলা সেখানে কাপড় ও ধান শুকানোর কাজ চলত, আর রাত হলে গল্পের আসর বসত। পরিবারের সবাই মিলে গল্পে মেতে উঠত, রাজা-রানির রূপকথা শুনে ঘুমিয়ে পড়তাম।”
বর্তমানে মাচাং ঘরের ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে। এর প্রধান কারণ বন উজাড়ের কারণে গাছ ও বাঁশের অভাব এবং আধুনিক পাকা ঘর নির্মাণের দিকে মানুষের ঝোঁক। বন থেকে আগের মতো সহজে গাছ ও বাঁশ পাওয়া যায় না, যা পাওয়া যায় তা কেনা বেশ ব্যয়বহুল। ফলে মাচাং ঘরের প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করা অনেকের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, সচ্ছল ব্যক্তিরা ইট-কংক্রিটের ঘর তৈরিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
অংম্রাচিং মারমা, চিমি ডলু পাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “আগে বন থেকে বাঁশ ও গাছ সংগ্রহ করে মাচাং ঘর তৈরি করা সম্ভব ছিল, কিন্তু এখন অনেক টাকা খরচ করে সেগুলো কিনতে হয়। তাই এখনকার ঘরের পাশে মাচাং অংশটা আর রাখব না, কেবল মূল ঘরটাই থাকবে।”
যদিও মাচাং ঘর নির্মাণে গাছ ও বাঁশের অভাব রয়েছে, তবুও কিছু ব্যক্তি এখনও ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। সুইনু প্রু মারমা, চিমি ডলু পাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “গাছ-বাঁশের দাম বাড়লেও আমাদের ঐতিহ্যবাহী ঘর তৈরি বন্ধ করব না। দূর থেকে হলেও গাছ ও বাঁশ সংগ্রহ করে মাচাং তৈরি করব। মাচাং ঘরের স্মৃতি আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
তাছাড়া, অনেকেই মাচাং ঘরের স্থায়িত্বের বিষয়ে উদ্বিগ্ন। এই ঘরগুলো সারা বছর প্রাকৃতিক রোদ-বৃষ্টির মধ্যে থাকে বলে দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অ্যাডভোকেট উছো অং মারমা, যিনি চট্টগ্রাম শহর থেকে পড়াশোনা করেছেন, বলেন, “মাচাং ঘর সাধারণত দুই-তিন বছরের বেশি স্থায়ী হয় না। তাই অনেকেই মাচাং ঘরের বদলে ইট-কংক্রিটের পাকা বাড়ি তৈরি করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।”
বান্দরবানের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক মংনুচিং মারমা বলেন, “একসময় মাচাং ঘর শহরেও দেখা যেত, কিন্তু আধুনিক স্থাপনার প্রতি ঝোঁক বাড়ায় এটি দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। আমাদের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে মাচাং ঘরকে ভিন্নভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এখন অনেকে মাচাং ঘরের জায়গায় পাকা বাড়ির লাগোয়া করে মাচাং ঘর তৈরি করছে, যা একটি ভালো উদাহরণ।”
মাচাং ঘর কেবল একটি স্থাপনা নয়; এটি পাহাড়ি সমাজের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যও বহন করে। এখানে পরিবারবর্গের একত্রিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়, যা পাহাড়ি সংস্কৃতির অংশ। মাচাং ঘরে গল্প বলা, উৎসব পালন, খাদ্য সংরক্ষণ ইত্যাদি নানা কাজে ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে এই ঐতিহ্যবাহী ঘর গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে আসে।
মাচাং ঘর টিকিয়ে রাখতে করণীয়
মাচাং ঘরের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সহযোগিতার প্রয়োজন। স্থায়ীভাবে টেকসই মাচাং ঘর নির্মাণের জন্য গবেষণার মাধ্যমে উপাদানের সংকট দূর করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, বনজ সম্পদ সংরক্ষণ এবং বাঁশ-গাছের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকার তরুণ প্রজন্মকে ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য সম্পর্কে সচেতন করতে স্থানীয় স্কুল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাচাং ঘর ও পাহাড়ি সংস্কৃতির উপর বিশেষ কর্মশালা আয়োজন করা যেতে পারে।
মাচাং ঘর পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যের প্রতীক এবং তাদের সামাজিক জীবনের অংশ। কিন্তু আধুনিক স্থাপনার প্রতিযোগিতা ও বনজ সম্পদের অভাবে এটি বিলুপ্তির পথে। মাচাং ঘর রক্ষা এবং পাহাড়ি স্থাপত্যশৈলীকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, স্থানীয় মানুষ এবং গবেষক সমাজকে একত্রে কাজ করতে হবে।