রবিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রচ্ছদআন্তর্জাতিক১৩২ বছর পর পুনরাবৃত্তি: গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পর ট্রাম্পের ইতিহাস...

১৩২ বছর পর পুনরাবৃত্তি: গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পর ট্রাম্পের ইতিহাস গড়া

নিজস্ব প্রতিবেদক

১৩২ বছর পর মার্কিন রাজনীতিতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের পর দ্বিতীয়বার হোয়াইট হাউসে ফিরলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এমন নাটকীয় প্রত্যাবর্তন খুব কমই দেখা গেছে। চার বছর আগে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে হোয়াইট হাউস ছাড়তে হয়েছিল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। একের পর এক বিতর্ক, মামলার বেড়াজাল, এবং সমালোচনার ঝড়ের মধ্যেও তিনি হাল ছাড়েননি। আর সেই অধ্যবসায়ের ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরতে যাচ্ছেন তিনি। এভাবেও ফিরে আসা যায়!

গত ১৩২ বছরে এমন ঘটনা মাত্র একবারই ঘটেছে। ১৮৯২ সালে ডেমোক্র্যাট নেতা গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ভোটে পরাজিত হওয়ার পর পুনরায় নির্বাচিত হয়ে হোয়াইট হাউসে ফিরেছিলেন। এবার সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটালেন রিপাবলিকান নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই জয় শুধুমাত্র তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্যই নয়, মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসেও একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।

নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়

২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেয়েছেন প্রায় ৭৪,২৯৮,৭২২ ভোট, যা মোট ভোটের ৫০.৫ শতাংশ। ইলেকটোরাল কলেজের ৩০১টি ভোট পেয়ে তিনি নিশ্চিত করেছেন তার নিরঙ্কুশ বিজয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক মানচিত্রে ‘লাল’ রঙের আধিপত্য লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২০ বছরের মধ্যে তিনিই প্রথম রিপাবলিকান প্রার্থী যিনি জাতীয় সাধারণ ভোটেও জয়লাভ করেছেন।

ফ্লোরিডায় বিজয় ভাষণে ট্রাম্প বলেন, “আমরা আমাদের সমালোচকদের ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি।” তার পাশে দাঁড়িয়ে হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স বলেন, “দেশের ইতিহাসে আমরা সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তনের সাক্ষী রইলাম।” এই জয় শুধু তাদের নয়, সমগ্র রিপাবলিকান পার্টির জন্য একটি বিশাল অর্জন।

বিতর্ক থেকে বিজয়ীর মঞ্চে

২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে। কিন্তু ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হন তিনি। সেই পরাজয় মেনে নিতে না পেরে নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করেন ট্রাম্প। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে তার সমর্থকদের সহিংস হামলার ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত হন। এছাড়াও জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনি ফলাফলে হস্তক্ষেপের অভিযোগসহ একাধিক মামলায় তিনি জড়িয়ে পড়েন।

তবুও থেমে থাকেননি ট্রাম্প। আইনি লড়াই চালিয়ে গেছেন, রাজনৈতিক ময়দানেও সক্রিয় থেকেছেন। রিপাবলিকান পার্টির অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা পেরিয়ে তিনি আবারও ডেমোক্র্যাটদের মুখোমুখি হয়েছেন। এবার তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। চূড়ান্ত ভোটযুদ্ধে তাকে পরাজিত করে ট্রাম্প পুনরায় প্রমাণ করেছেন তার রাজনৈতিক শক্তিমত্তা।

ক্যাসিনো ব্যবসা থেকে শোবিজ

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জীবন সবসময়ই চাঞ্চল্যকর। ব্যবসায়ী হিসেবে তার পরিচিতি সবারই জানা। ১৯৮৪ সালে তিনি ক্যাসিনো ব্যবসায় পা রাখেন। নিউজার্সির আটলান্টিক সিটিতে তার মালিকানাধীন ‘ট্রাম্প তাজমহল’ ক্যাসিনোটি ছিল সে সময়ের অন্যতম আলোচিত প্রতিষ্ঠান। তবে ত্রুটিপূর্ণ স্লট মেশিনের কারণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড এবং অন্যান্য সমস্যার কারণে এই ব্যবসা বেশিদিন টেকেনি। ২০১৪ সালে ক্যাসিনোটি বন্ধ হয়ে যায়, ফলে বহু কর্মী চাকরি হারান। পরে হার্ডরক ইন্টারন্যাশনাল ক্যাসিনোটি কিনে আবারও চালু করে।

শুধু ব্যবসা নয়, শোবিজ জগতেও ট্রাম্পের পদচারণা ছিল উল্লেখযোগ্য। ২০০৩ সালে তিনি এনবিসি টেলিভিশনে ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’ নামে একটি রিয়েলিটি শো শুরু করেন। এই শো তাকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এছাড়াও তিনি মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ এবং মিস টিন ইউএসএ প্রতিযোগিতার আয়োজক প্রতিষ্ঠানটির মালিক ছিলেন।

trump ডোনাল্ড ট্রাম্প

বিতর্ক তার ছায়াসঙ্গী

ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনে বিতর্কের শেষ নেই। ক্যাপিটল হিল হামলা থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি, জালিয়াতি, ঘুষসহ বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। নিউইয়র্কের আদালতে তার বিরুদ্ধে পর্ন তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে মুখ বন্ধ রাখতে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ব্যবসায়িক নথিপত্রে জালিয়াতির অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

তবে এসব বিতর্ক ও অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে তিনি আবারও হোয়াইট হাউসে ফিরতে যাচ্ছেন। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রেসিডেন্ট হলেও তার বিরুদ্ধে চলমান মামলাগুলো অব্যাহত থাকবে। ১৯৯৭ সালের সুপ্রিম কোর্টের রুলিং অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট দেওয়ানি মামলায় দায়মুক্তি পান না।

চাঞ্চল্যকর জীবনযাত্রা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের জীবন বরাবরই চমকপ্রদ। নিউইয়র্ক শহরে ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ফ্রেড ট্রাম্প ছিলেন একজন বিত্তশালী রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী। ছোটবেলা থেকেই ডোনাল্ড ছিলেন চঞ্চল প্রকৃতির। ১৩ বছর বয়সে দুষ্টুমি করার কারণে তাকে সামরিক অ্যাকাডেমিতে পাঠানো হয়। পরে পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেন।

বিশ্ব রাজনীতিতে ট্রাম্পের প্রভাব

ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বিশ্ব রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আসবে তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি, যদিও কীভাবে তা করবেন তা স্পষ্ট করেননি।

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক রয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারেন তিনি। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কেও পরিবর্তন আনতে পারেন ট্রাম্প। শুল্ক আরোপ করে চীনা পণ্যের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন তিনি।

ট্রাম্প টাওয়ার: সাফল্যের প্রতীক

নিউইয়র্কের ‘ট্রাম্প টাওয়ার’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যের প্রতীক। ১৯৮৩ সালে নির্মিত এই আকাশচুম্বী ভবনটি তার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার কেন্দ্রস্থল। বিলাসবহুল এই ভবনটি শুধু ব্যবসার জন্যই নয়, পর্যটকদের কাছেও আকর্ষণীয়।

অঢেল সম্পদের মালিক

ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন। তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৪.৫৯ বিলিয়ন ডলার। রিয়েল এস্টেট, শোবিজ, বিনিয়োগসহ বিভিন্ন খাত থেকে তিনি এই সম্পদ অর্জন করেছেন। ‘দ্য অ্যাপ্রেনটিস’ শো থেকে তিনি বিপুল অর্থ উপার্জন করেছেন। এছাড়াও তার লেখা বই ‘দ্য আর্ট অব দ্য ডিল’ এবং ‘লেটার্স টু ট্রাম্প’ তাকে আর্থিকভাবে আরও সমৃদ্ধ করেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্পে জীবন ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নানা ঘটনার মোড়কে মোড়া। বিতর্ক, সমালোচনা, সাফল্য সবকিছু নিয়েই তিনি এগিয়ে চলেছেন। ১৩২ বছর পর মার্কিন রাজনীতিতে তিনি যে নজির গড়েছেন, তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এখন দেখার বিষয়, তার দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেন।

এই বিভাগের আরও পড়ুন