ভোক্তাদের মধ্যে বোতলজাত সয়াবিনের চাহিদা বেশি হলেও পণ্যটির বাজার ঘিরে তৈরি হয়েছে সংকট। দুই দফায় শুল্ক কমানোর পরও সরকারিভাবে সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য সংশোধন না করায় পণ্য সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন মিল মালিকরা। ফলে ভোক্তা পর্যায়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে বোতলজাত সয়াবিনের। পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতারা আগের কেনা সয়াবিন বাড়তি মুনাফায় বেশি দামে বিক্রি করায় এ সংকট আরো তীব্র হয়েছে।
আমদানিকারক মিল মালিকরা বলছেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে দেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার ফলে ভোজ্যতেলের আনুষ্ঠানিক দাম বাড়াতে চাচ্ছে না সরকার। এ কারণে দুই দফায় ছাড় দেয়া হয়েছে শুল্কও। এরই মধ্যে শুল্ক ছাড়ের আওতায় সয়াবিন তেল আমদানিও হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববাজারে পাম অয়েল ও সয়াবিনের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় শুল্কছাড় সত্ত্বেও বিদ্যমান দামে সয়াবিন তেল বিক্রিতে অনীহা দেখাচ্ছেন তারা।
এ কারণে সরবরাহ বন্ধ রেখে বোতলজাত সয়াবিনের মূল্য পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন মিল মালিকরা। গত বৃহস্পতিবার সয়াবিনের দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন মিল মালিকরা। তবে পণ্যটির দাম বাড়ানোর বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি তারা। আগামী সপ্তাহে বিষয়টি নিয়ে আবার বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। তখন বোতলজাত সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম পুনর্নির্ধারণ করা হতে পারে বলে মনে করছেন তারা।
মূলত বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় শুল্ক ছাড় সত্ত্বেও আগের দামে বিক্রি করা যাচ্ছে না বলে দাবি আমদানিকারকদের। তাদের দাবি, পরিশোধন ও বাজারজাতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় আগের দামে সয়াবিন তেল বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের নভেম্বরের পিঙ্ক শিট প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের টনপ্রতি বুকিং দর ২০২৩ সালের গড় দামকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৩ সালে টনপ্রতি বুকিং দর ছিল ১ হাজার ১১৯ ডলার। গত নভেম্বরে পণ্যটির গড় বুকিং ছিল ১ হাজার ১৪৫ ডলার।
অন্যদিকে ২০২৩ সালে অপরিশোধিত পাম অয়েলের বুকিং দর ছিল ৮৮৬ ডলার। গত নভেম্বরে পাম অয়েলের গড় বুকিং দর ছিল ১ হাজার ১৬৯ ডলার। কয়েক মাসের মধ্যে অপরিশোধিত পাম অয়েলের বুকিং দর বেড়েছে ১৮৬ ডলার।
কয়েক মাসের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব বিদ্যমান বলে দাবি করছেন সরবরাহকারীরা। দেশে ভোজ্যতেল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের পরিচালক (করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের বুকিং দর বেড়েছে। সরকার আগের দাম ধরে রাখতে শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মিল মালিকদের পক্ষ থেকে কয়েক দফায় দাম বাড়ানোর প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে।’
এদিকে বাজারে সয়াবিনের সরবরাহ সংকটের আরেকটি কারণ পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধি। স্বাভাবিকভাবে দেশের বাজারে পাম অয়েলের তুলনায় সয়াবিনের দাম বেশি হলেও সম্প্রতি বিশ্ববাজারে পাম অয়েলের বুকিং দর সয়াবিনকে ছাড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগে ইন্দোনেশিয়ায় বায়োডিজেল বা উদ্ভিজ্জ তেল দিয়ে উৎপাদিত জ্বালানি তেল উৎপাদনে পাম অয়েলের ব্যবহার আগের তুলনায় বাড়ানোর ফলে বিশ্ববাজারে পণ্যটির চাহিদা ও মূল্য বেড়েছে।
এদিকে সয়াবিনসহ ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত অক্টোবরে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন বা পাম অয়েল উৎপাদনে এবং ব্যবসায়িক পর্যায়ে প্রযোজ্য ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) মওকুফ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আরেক আদেশে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়।
ভোজ্যতেলের দাম কমানোর লক্ষ্যে নেয়া পৃথক দুটি সিদ্ধান্তের পরও পাইকারি বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে লিটারপ্রতি ১০-১৫ টাকা। দুই দফায় শুল্ক কমানোর পরও লোকসান এড়ানোর কথা বলে খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন সরবরাহ বন্ধ করে দেন মিল মালিকরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) সয়াবিন (সরবরাহ আদেশ বা এসও) লেনদেন হচ্ছে ৬ হাজার ৪০০ টাকায়। মিলগেট থেকে এসব সয়াবিন খুচরা পর্যায়ে যেতে মণে কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হয়। ওই হিসাবে পাইকারি থেকে খুচরা বাজারে সয়াবিন সরবরাহ হচ্ছে ৬ হাজার ৬০০ টাকায়।
পাইকারি ব্যবসায়ী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের লভ্যাংশসহ ভোক্তারা বর্তমানে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকা কেজি দরে খোলা সয়াবিন কিনছেন। যদিও সরকারিভাবে লিটারপ্রতি সয়াবিন তেল মোড়কে নির্ধারিত দাম ১৬৮ টাকা। ফলে মোড়কজাত সয়াবিন তেল বোতল থেকে বের করে খোলা বিক্রি করলে বাড়তি লাভের সুযোগ থাকছে ব্যবসায়ীদের।
চট্টগ্রামের কালুরঘাট এলাকার মেসার্স মালতী এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক সঞ্জয় দে বলেন, ‘কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন দিচ্ছে না। তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খোলা সয়াবিনের দাম বেশি হওয়ায় লোকসানের কারণে সয়াবিন বোতলজাত করা হচ্ছে না।’